শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


শিষ্টের দমন দুষ্টের পালন : আইনের উল্টোপথ যাত্রা এবং ‘পাপচক্র’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

Untitleeed-2জাকির মাহদিন: কোনো মানুষই আইনের উর্ধ্বে নন। তবে শর্ত একটাই- আইনকে যথার্থই ‘আইন’ হতে হবে; কথিত শক্তিশালী বা ক্ষমতাবানের অন্যায়ের হাতিয়ার কিংবা দুষ্টদের ‘পাপচক্র’ নয়। আইন নিয়ে পর্যালোচনাসাপেক্ষে প্রশ্ন তোলার অধিকার থাকবে, সময়ের সঙ্গে মৌলিক আইনের শাখা-প্রশাখাগুলোর রূপান্তর ও বিস্তৃতি ঘটবে। প্রয়োজনে পরিবর্তন কিংবা নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। আইন প্রণেতা, ব্যাখ্যাতা ও বিচারক নিজেও যেহেতু আইনের অধীন এবং সমকালীন সমাজ, শিক্ষা, পরিবেশ, দল, গোষ্ঠী, প্রচারণা, অর্থ প্রভৃতি দ্বারা প্রভাবিত, তাই কোনো মানুষের পক্ষ থেকেই নিরপেক্ষ ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর আইন এবং বিচার আশা করা যায় না। সেজন্য বিভিন্ন আইন ও আইনের খুঁটিনাটি নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা পর্যালোনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই বিরামহীন গতিতে চালিয়ে যেতে হবে। যে কোনো আইনের বাস্তব ও দূরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলকে গুরুত্ব দিয়ে, তাৎক্ষণিক ও পক্ষপাতমূলক আইনগুলো দ্রুত সংশোধন বা বিলুপ্ত করে, প্রচলিত আইনগুলোর বাস্তব সমস্যা উপলব্ধি করে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আইন প্রণেতা, ব্যাখ্যাতা ও বিচারককে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত অনুসন্ধান, জ্ঞান-গবেষণা, বিকল্প শিক্ষা ও সমকালীন সমাজ-পরিবেশ-প্রচারণা-দল-গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত থাকার সর্বাধিক সাধনা অবশ্য করণীয়।

মানুষের মৌলিক অধিকার জন্মগত এবং এমন স্বতসিদ্ধ যে তা নির্দিষ্ট কোনো আইন বা সংবিধান নতুন করে দিতে হয় না। বরং বাধ্যবাধকতার স্তরে স্বীকার ও পৌঁছে দেয়ার ওয়াদা করেই যে কোনো আইন বা সংবিধান রচনা করতে হয়। তা না হলে সেটা আইন বা সংবিধান হবে না।

পৃথিবীতে বহু যুক্তিবাদী, দার্শনিক, আইনপ্রণেতা গত হয়েছেন। বর্তমানেও যথেষ্টই আছেন। অধিকাংশেরই যুক্তি-দর্শন-আইন স্ববিরোধিতা, বিপরীতমুখিতা ও সাংঘর্ষিকতায় ভরপুর। এরা অনর্গল যুক্তি দিতে পারেন, কিন্তু যুক্তির পেছনের যুক্তিটি কী তা বলতে পারেন না। ‘দর্শনের দর্শন’ দেখাতে পারেন না। আইনের মূল উদ্দেশ্য এবং সূত্র নির্দেশ করতে পারেন না। সামান্য যা বলেন বাস্তবে তার কোনো দেখা নেই। যে ‘সূত্র’ বয়ান করেন তাকে সূত্র না বলে অন্যকিছু বলাই সঙ্গত। তাই নতুন করে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এসবের মূল উদ্দেশ্য এবং সূত্র কী? প্রথমে উদ্দেশ্য নিয়েই কথা বলা যাক। সমস্ত আইনের মূল উদ্দেশ্য (একইসঙ্গে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও বিশ্বজনীন) মানবকল্যাণ। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। যদি কোনো আইন সৎ ও সততার সহযোগিতা না করে, চিন্তা ও জ্ঞানের বিকাশ না ঘটায় তবে সেটা আইন নয়। কোনো আইন বা ‘আইনচক্র’ যদি ভালো ও কল্যাণকর কোনো উদ্যোগকে বিলম্বিত করে, বাধা দেয়, মূল্যবান সময় নষ্ট করে, অর্থের অপচয় করে, দুষ্টদের খেল-তামাশার সুযোগ সৃষ্টি করে তবে সেটা ‘আইন’ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সংবিধান হল নির্দিষ্ট কোনো রাষ্ট্রীয় আইনের সমষ্টি। যে সংবিধান নিরপেক্ষ নিরপরাধ ব্যক্তির অধিকার সংরক্ষণ করবে না, সৎ নাগরিকের সহযোগিতা করবে না, কল্যাণকর উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে না ও স্বীকৃতি দেবে না, সেটা সংবিধান নয়। আর যদি বাস্তবিক পক্ষেই তা সংবিধান হয়ে থাকে তাহলে যে কোনো সৎ নাগরিকের চিন্তা, বাকস্বাধীনতা ও অন্যান্য সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিতভাবে এতে সংরক্ষিত। মহৎ উদেশ্যের বিশেষ কাজগুলো অবশ্যই সংবিধানসম্মত ও স্বীকৃত। কেবল দুষ্টরা এর ‘ভুল ব্যাখ্যা’ করে থাকে। মানুষের মৌলিক অধিকার জন্মগত এবং এমন স্বতসিদ্ধ যে তা নির্দিষ্ট কোনো আইন বা সংবিধান নতুন করে দিতে হয় না। বরং বাধ্যবাধকতার স্তরে স্বীকার ও পৌঁছে দেয়ার ওয়াদা করেই যে কোনো আইন বা সংবিধান রচনা করতে হয়। তা না হলে সেটা আইন বা সংবিধান হবে না। অবশ্য বিশেষ কোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠীর বিশেষ কোনো কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা বিবেচনা তথা নিষ্পত্তির জন্য ব্যাপক পর্যালোচনা, অনুসন্ধান ও নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।

মৌলিক মানবিক অধিকার রক্ষা করতে হলে, আইন-বিচার-গণতন্ত্র-ধর্মের প্রকৃত সংজ্ঞা উদ্ধার করতে হলে মানবমনের সুপ্ত চাহিদা ও আকর্ষণের প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করতে হবে। মানুষ, মানুষের চাহিদা, মানজীবনের উদ্দেশ্য, সমাজ প্রভৃতি শব্দগুলো নিয়ে বিস্তর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে। এসব চিন্তা-গবেষণা কঠিন বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পথ নেই। কেননা এর অভাবে সমাজে যে বাস্তবতা দেখা দেবে অর্থাৎ যে বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও রক্তপাতের সৃষ্টি হবে তা আরো কঠিন। ভয়াবহ কঠিন। এমনটা কোনো মানুষই চায় না।

মানুষ মানুষের জন্য। প্রত্যেক মানুষই জন্মগতভাবে বিশ্ব নাগরিক। মানবতা বিশ্বজনীন। সমস্ত মানুষের শারীরিক-মানসিক মৌলিক চাহিদা এক; আশা-আকাক্সক্ষা এক। সুতরাং মৌলিক আইন-কানুন, শিক্ষা, জ্ঞান ও বিচারব্যবস্থাও একই হবে এতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। পারিপার্শ্বিক ভিন্নতাগুলো বৃহৎ পরিসরে অনুল্লেখ্য। প্রায় প্রত্যেক মানুষের মনোজগতে মৌলিক আইন, স্থির সত্য ও ন্যায়-নীতির প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ সুপ্ত থাকে। বিপরীত উপাদানগুলো থাকে প্রকাশ। এই প্রকাশ্য বিপরীত উপাদানগুলোই কখনো কখনো পুরো সমাজ, দেশ বা বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলে। তখন আইন, বিচার, গণতন্ত্র, ধর্ম সবই মৌলিক মানবিক অধিকারের বিপক্ষে চলে যায়। সেক্ষেত্রে মৌলিক মানবিক অধিকার রক্ষা করতে হলে, আইন-বিচার-গণতন্ত্র-ধর্মের প্রকৃত সংজ্ঞা উদ্ধার করতে হলে মানবমনের সুপ্ত চাহিদা ও আকর্ষণের প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করতে হবে। মানুষ, মানুষের চাহিদা, মানজীবনের উদ্দেশ্য, সমাজ প্রভৃতি শব্দগুলো নিয়ে বিস্তর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে হবে। এসব চিন্তা-গবেষণা কঠিন বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পথ নেই। কেননা এর অভাবে সমাজে যে বাস্তবতা দেখা দেবে অর্থাৎ যে বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও রক্তপাতের সৃষ্টি হবে তা আরো কঠিন। ভয়াবহ কঠিন। এমনটা কোনো মানুষই চায় না।

ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামষ্টিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে মানুষের অভ্যন্তরীণ শক্তি-সামর্থগুলো অনুসন্ধান করা বিশেষত এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে খুবই জরুরি। এই জীবন ক্ষণিকের জন্য। মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু একটি জীবন অতীব মূল্যবান। এই জীবনকে আমরা কিভাবে সাজাব, উপভোগ করব, সমগ্র সৃষ্টি এবং মহাবিশ্বকে এই ক্ষুদ্র জীবনে কিভাবে কাজে লাগাব, এমনকি মৃত্যুকেও আমরা কিভাবে ব্যবহার করব সেই বিষয়গুলো আলোচনার দাবি রাখে। এক একটি জন্ম সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে ভরপুর। কিন্তু পরবর্তীতে চারদিকের তিক্ত বাস্তবতা সেই উল্লাস সহসা থামিয়ে দেয়। প্রতিটি জীবন একদিকে আনন্দ-উল্লাসে কাঁপা, অন্যদিকে সীমাহীন অভাব ও সমস্যার নরক-যন্ত্রণায় নীল- এ চূড়ান্ত বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়ে। আমরা আজ চব্বিশ ঘণ্টা কী নিয়ে ব্যস্ত? প্রাত্যহিক চাহিদা, জাগতিক আশা-আকাক্সক্ষা, হিংসা-প্রতিহিংসা ও কর্মব্যস্ততার বাইরে আর কোনো জীবন বা বিশেষত্ব নেই? যদি থাকে তবে সেই জীবন ও বিশেষত্বের অনুসন্ধান এবং পর্যালোচনা ছাড়া কোনো আইন, নিয়ম-নীতি সুষ্ঠু হতে পারে? জেল-জরিমানা, মামলা-হয়রানি সবার জন্য কল্যাণকর হতে পারে? প্রতিপক্ষকে একের পর এক ঘায়েল করতে পারলেই কি শান্তি? ক্ষণিকের ভোগ-উপভোগই জীবন?

সমালোচনাপ্রার্থী
zakirmahdin@yahoo.com

এফএফ


সম্পর্কিত খবর