শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


মাদরাসা থেকে ভালো আলেম বেরুচ্ছে, তাই বলে সংস্কার হবে না তা ঠিক নয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

hasan jamilমাওলানা হাসান মুহাম্মদ জামিল। একজন দায়ী মুসলিম স্কলার হিসেবে সমধিক পরিচিত। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার পরিচিত মুখ। বহুমুখী ফিতনার মোকাবেলায় অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। সোশ্যাল মিডিয়াও তাঁর সরব পদচারনায় মুখরিত। বক্তব্যে স্পষ্টবাদী। চিন্তা ও কর্মে পূর্বসূরীদের পথধারী। দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ইসলামী অনুষ্ঠানে প্রায়ই অংশগ্রহণ করেন এই মানুষটি। দেশের সীমা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও তার দাপুটে অংশগ্রহণ বরাবরই পরিচিত। এই সরল, সজ্জন মানুষটির সাথে কথা হয় এক সন্ধ্যায়। ইলেক্ট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়া সংক্রান্ত বহু প্রশ্নের সরল ও ভারসাম্যপূর্ণ জবাব দিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রোকন রাইয়ান আবু সাঈদ জোবায়ের

আওয়ার ইসলাম: আসসালামুআলাইকুম। প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের সময় দেয়ার জন্য।

মাওলানা হাসান জামিল: ওয়ালাইকুমুস সালাম। আপনাদেরও ধন্যবাদ।

আওয়ার ইসলাম: ইসলাম প্রচার তথা দাওয়ার ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকা কতুটুকু?

মাওলানা হাসান জামিল:  বর্তমান সময়ে এই প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক। একসময় আমাদের মূলধারার ওলামায়ে কিরাম এ বিষয়টিকে অপছন্দ করতেন। তবে বর্তমানে এটি দাওয়ার একটি শক্তিশালী মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমেই কেবল মানুষের বেডরুম পর্যন্ত দাওয়াত পৌঁছানো সম্ভব। এ প্রসঙ্গে আমি দুটি কথা বলব।

১. ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ছাড়া নারীদের কাছে দাওয়াত পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। কারণ, সাধারণ ওয়াজ মাহফিলগুলোতে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ অনেকাংশেই সম্ভব হয় না। তাই, নারীদের মাঝে ইসলাম বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

২. প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করার জন্য তাদের উপযোগী মাধ্যম নির্বাচন প্রয়োজন। অগ্রসরমান বিশ্বে মিডিয়া একটি বড় মারণাস্ত্র। তাই ইসলামের প্রচার প্রসারে এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ কারণগুলো সামনে রেখেই আমি বলব, মিডিয়া বর্তমানে দাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

আওয়ার ইসলাম: প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন এসে যায়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তো অনেক খারাপ বিষয়ও থাকে। যেগুলো ইসলামি শরিয়ার পরিপন্থী। সেক্ষেত্রে কী করণীয়?

মাওলানা হাসান জামিল:  প্রথম কথা হল, আমরা কাউকে টেলিভিশন ব্যবহার করার ব্যাপারে উৎসাহিত করি না। হ্যাঁ, যাদের বাসায় টিভি আছে তারা তো এটি ব্যবহার করবেই। তাই তাদের জন্য একটু ভাল কিছু করার প্রচেষ্টা। যিনি টিভি দেখছেন, সব আয়োজনের ফাঁকে তিনি যেন একটু ইসলাম পেয়ে যান সেটিই আমাদের প্রচেষ্টা।

[caption id="attachment_9199" align="alignright" width="446"]hasan jamil3 ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ছাড়া নারীদের কাছে দাওয়াত পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। কারণ, সাধারণ ওয়াজ মাহফিলগুলোতে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ অনেকাংশেই সম্ভব হয় না। তাই, নারীদের মাঝে ইসলাম বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।[/caption]

আওয়ার ইসলাম: প্রথম কিভাবে মিডিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিলেন?

মাওলানা হাসান জামিল: আসলে প্রথম অংশগ্রহণ কিছুটা বিপদসংকুল ছিল। আজ থেকে আট দশ বছর আগে প্রথম মিডিয়ায় যাই। তখন অনেক উলামায়ে কিরাম একে ভিন্ন চোখে দেখতেন। তবে বর্তমানে এ দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। বিশেষত, দারুল উলুম দেওবন্দের স্বনামধন্য মুহাদ্দিস আল্লামা আরশাদ মাদানি হাফিজাহুল্লাহ কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফরে এসে এ বিষয়ে ওলামায়ে কিরামের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

আওয়ার ইসলাম: ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপারে আরেকটি কথা উচ্চারিত হয়, কতজন মানুষই বা মিডিয়ার মাধ্যমে হেদায়েত পেয়েছেন। অর্থাৎ, এর মাধ্যমে ঠিক কতজন মানুষ আপাদমস্তক পাল্টেছেন?

মাওলানা হাসান জামিল:  আসলে দেখুন, ইসলাম দুটি জিনিসের সমন্বয়। প্রথমত এর প্রচার প্রসার। দ্বিতীয়ত এর সুরক্ষা। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারের পাশাপাশি সুরক্ষাও হয়। আকাশ সংস্কৃতিতে খারাপ অনেক কিছুই আছে। এর কিছুটা ইসলামাইজেশন হলে মন্দত্ব কিছুটা তো ঘুঁচল। একজন মানুষ আপাদমস্তক পাল্টে না গেলেও তিনি খারাপ জিনিসের সংস্পর্শ থেকে কিছুটা তো বাঁচলেন। আর আপাদমস্তক কিসের মাধ্যমে পরিবর্তন হবে সেটা তো আল্লাহ পাকের হাতে। আমাদের দায়িত্ব হলো প্রচার করে যাওয়া।

আওয়ার ইসলাম: ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারের পদ্ধতিটি কেমন?

মাওলানা হাসান জামিল: সময়ের সাথে সংগতি রেখে বলা যায় এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

আওয়ার ইসলাম: ইসলাম নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন দলের মাঝে একটা দূরত্ব পরিলক্ষিত হয়। এর কারণ কী?

মাওলানা হাসান জামিল:  আসলে যারাই ইসলাম নিয়ে কাজ করবেন, তাদের সবার মাঝে ঐক্য ও পারস্পারিক সৌহার্দ অত্যন্ত জরুরি। যিনি যেই অঙ্গনেই কাজ করুন না কেন, আর বাকি সবার প্রতি তার ভালবাসা একান্ত কাম্য। কারণ সবার উদ্দেশ্য তো এক। সবাই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাজ করছেন। এক্ষেত্রে পারস্পরিক কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি অত্যন্ত নিন্দনীয়।

আওয়ার ইসলাম: সোশ্যাল মিডিয়া ইসলাম প্রচারের কেমন মাধ্যম বলে মনে করেন?

মাওলানা হাসান জামিল: এটি একটি স্পর্শকাতর মাধ্যম। এবং একটি কার্যকর মাধ্যমও বটে। এখানে পদস্খলন খুব স্বাভাবিক। তবে যেহেতু প্রচুর মানুষ এর সাথে যুক্ত হচ্ছেন তাই এই মাধ্যম আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এটিও দাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে।

আওয়ার ইসলাম: আমরা জানতে পেরেছি আপনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াতের কাজ করে যাচ্ছেন। এবিষয়ে কিছু জানতে চাই।

মাওলানা হাসান জামিল: আসলে অমুসলিম বলতে আমরা ভিন্নধর্মীদের মাঝে ইসলামের কাজ করে যাচ্ছি, বিষয়টি এমন নয়। বরং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন এনজিও এবং মিশনারীগুলোর তৎপরতার ফলে বহু মানুষ ইসলাম ত্যাগ করেছে। তারা মানুষকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নগদ অর্থ দিয়ে খৃস্টান বানাচ্ছে। তাদের আবার ইসলামের মাঝে ফিরিয়ে আনার কিছু প্রচেষ্টা আমরা করছি। এক্ষেত্রে বলা যায়, প্রয়োজনের তুলনায় কোন কাজ হচ্ছেই না। আমরা যৎসামান্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। ব্যপক জাগরণ ছাড়া এর সমাধান সম্ভব নয়।

আওয়ার ইসলাম: এক্ষেত্রে কাজ কম হওয়ার কারণ কী?

মাওলানা হাসান জামিল: মৌলিকভাবে দুটি কারণ আমি বলব। ১. যারা এই কাজে নিজেকে প্রবৃত্ত করবেন, তারা ব্যক্তিগতভাবে অনেক ঝুঁকির সম্মুখীন হন। বিভিন্ন এনজিও এবং তাদের এদেশের সহযোগীরা জঙ্গিবাদসহ নানা অপবাদ দেয় তাদের। ফলে তারা নানা হয়রানির শিকার হন।

২. আরেকটি কারণ হল অর্থসংকট। একাজে প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। আমরা এখনো এতটা সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারিনি যাতে জনসাধারণের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।

[caption id="attachment_9200" align="alignright" width="282"]hasan jamil2 অনেক আরবী ব্যাকরণ বা ফিকহের কিতাব ফার্সীতে। সেটি আবার অনেকে ক্লাসে অনুবাদ করেন উর্দুতে। আর পড়ে বাংলাভাষা ভাষীরা। এতে মূল বিষয়ের সাথে একটি বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়।[/caption]

আওয়ার ইসলাম: কওমী মাদ্রাসার সিলেবাস এবং এর সংস্কার বিষয়ে বেশ আলোচনা চলছে, এ বিষয়ে কিছু বলুন।

মাওলানা হাসান জামিল: এব্যাপারে প্রথম কথা হল, কওমী মাদ্রাসার চলমান এই সিলেবাস থেকেই আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভাল আলেম বেরুচ্ছে। যারা দীনের বিভিন্ন অঙ্গনে বহুমুখী খেদমত করে যাচ্ছেন। তবে এর মানে এই নয়, এই সিলেবাসে কোন ধরনের পরিবর্তন হবে না। এক সময় আলেমরা ইংরেজির ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন। এখন এটি পরিবর্তন হয়েছে। দাওয়ার জন্য ইংরেজি খুবই প্রয়োজন। যেহেতু আমাদের মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোটা জগতের জন্য প্রেরিত হয়েছেন, তাই ইংরেজি জানা থাকলে দাওয়ার পরিধি অনেক বেড়ে যায়। ইলমী বিভিন্ন গবেষণার কাজেও এর প্রয়োজন পড়ে।

আওয়ার ইসলাম: সিলেবাসে কোন ধরনের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন?

মাওলানা হাসান জামিল: একটি প্রসঙ্গ বলি, আমাদের সিলেবাসে অনেক ফার্সী কিতাব আছে। আমি নিজেও প্রায় আটটি কিতাব ফার্সীতে পড়েছি। অনেক আরবী ব্যাকরণ বা ফিকহের কিতাব ফার্সীতে। সেটি আবার অনেকে ক্লাসে অনুবাদ করেন উর্দুতে। আর পড়ে বাংলাভাষা ভাষীরা। এতে মূল বিষয়ের সাথে একটি বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। উর্দূর কিছুটা আবেদন এখনো আছে। কারণ, ইলমী কিতাবাদির একটি বিরাট অংশ এখনো উর্দূ ভাষায় রয়ে গেছে। তারওপর ভারত ও পাকিস্তানের ওলামায়ে কিরাম আমাদের ভৌগলিক প্রতিবেশী। তাই সমসাময়িক বিষয়াদিতে তাদের সাথে পরামর্শ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ ভাষাটি গুরুত্বপূর্ণ। তাই উর্দূতে কিছুটা দক্ষতা প্রয়োজন।

আওয়ার ইসলাম: আমাদের সিলেবাসে অনেক পুরনো কিতাব আছে। এগুলোতে কিছু পরিবর্তন করে যদি নতুন কিতাব নেয়া হয়, তাহলে কি নতুন লেখক উঠে আসবে না?

মাওলানা হাসান জামিল: এমনটি তো আশা করা যায়। এজন্য আমাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। আমার এক সহপাঠী আরবিতে নাহবেমীর কিতাবের একটি শরাহ লিখেছেন। তিনি তা বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়্যাহকেও দিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকে তা গ্রহণ করেনি। এই অবস্থান থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। আল্লাহ তাআলা তাওফিক দান করুন।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ