শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


জাকির নায়েকের বক্তব্য চোখ বন্ধ করে গ্রহণের সুযোগ নেই

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

shamsabadiমুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী। মাসিক আদর্শ নারীর সম্পাদক। ডা. জাকির নায়েকের লেকচার নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন থেকে। এ বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেনও প্রায় পাঁচ বছর। সম্প্রতি গুলশানে হামলাকারীদের দুজন ডা. জাকির নায়েকের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হওয়ার অভিযোগের পর ভারত ও বাংলাদেশে পিসটিভির সম্প্রচার বন্ধ হয়েছে। আলোচনা সমালোচনা চলছে ডা. জাকির নায়েকের লেকচার নিয়েও। এসব বিষয়ে মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম সাব এডিটর এহসানুল হক

আওয়ার ইসলাম : জাকির নায়েক বর্তমান সময়ের একজন আলোচিত ইসলামি ব্যক্তিত্ব। সাধারণ মানুষদের মাঝে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়। তার ব্যাপারে আপনি অনেক লেখালেখি করেছেন। সংক্ষেপে আমরা জাকির নায়েকের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই?
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী : ডা. জাকির নায়েক প্রথমে যখন ইসলামের দাওয়াহর অঙ্গনে তাক লাগানো বাগ্মিতার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে ইসলামের সত্যতা তুলে ধরেন, তখন মুসলমানদের মধ্যে আশার আলো জাগে। সে জন্য অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। আর তখন বিশ্বের আলেমগণও তার এ আশাব্যঞ্জক ভূমিকাকে স্বাগত জানান।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কিছুদিন যেতে না যেতেই ডা. জাকির নায়েকের লেকচারে ইসলামের মৌলিক আকিদা ও নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক বিভিন্ন বিষয় পরিলক্ষিত হতে থাকে। যা তার প্রতি মুসলমানদের উচ্চাশাকে নিরাশায় পর্যবসিত করে।
এর পেছনে এ কারণ থাকতে পারে, তিনিতো সরাসরি মূল কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে ইসলামের জ্ঞান অর্জন করেননি, বরং বিভিন্নজনের অনুবাদ পড়ে তিনি এ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছেন; আর তার এ জ্ঞান অর্জন অনেক ক্ষেত্রে কোন সহিহ উৎস থেকে না হয়ে বাতিলপন্থীদের লেটারেচারের মাধ্যমে তিনি তার দ্বীনি জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছেন বলে মনে হয়। যার দরুণ তাদের অনেক ভ্রান্ত বিষয় তার লেকচারে স্থান পেয়েছে।

আওয়ার ইসলাম : জাকির নায়েকের সে ত্রুটিগুলো কী রকম?
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী :আমি আমার লেখায় ডা. জাকির নায়েকের আলোচনায় ৬০টির অধিক ত্রুটিযুক্ত বিষয় তুলে ধরেছি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় হলো-
১. ডা. জাকির নায়েক বলেছেন, ‘মুহাম্মদ সা.-এর উপর ঈমান না আনলেও জান্নাতে যাওয়ার .০০১ পারসেন্ট চান্স আছে।’
২৮ আগস্ট-২০০৯ দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত Misconception About Islam শীর্ষক পিস কনফারেন্সের প্রশ্নোত্তর পর্বে ডা. জাকির নায়েককে ‘রাহুল’ নামের এক অমুসলিম যুবক প্রশ্ন করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ঈমান রাখলো, কিন্তু নবি মুহাম্মদ সা.-এর ওপর ঈমান রাখলো না, সে কি জান্নাতে যেতে পারবে? এ প্রশ্নের উত্তরে ডা. জাকির নায়েক বলেন- ‘যে ব্যক্তি এক আল্লাহর উপর ঈমান রাখে, সে যদি মুহাম্মদ সা.-এর ওপর ঈমান না রাখে, তার জান্নাতে যাওয়া খুব কঠিন হবে, তার জান্নাতে যাওয়ার .০০১ পারসেন্ট চান্স আছে। তার উদাহরণ হলো কোন বহুতল ভবন যেমন বুরুজ-দুবাই থেকে নিচে পড়া ব্যক্তির মতো। যার মারা যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি এবং বেঁচে থাকার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে।’

এটা নিঃসন্দেহে ডা. জাকির নায়েকের মারাত্মক ঈমানধ্বংসী বক্তব্য। যা বিশ্বাস করলে মানুষ ঈমানহারা হয়ে কাফির হয়ে যাবে। বস্তুত কোন ব্যক্তি ইসলামের সবকিছু মেনেও মাত্র একটি আকিদা বা ঈমানের কোন একটি বিষয়কেও অস্বীকার করলে সে কাফের হয়ে যায়। সুতরাং কেউ রাসূলুল্লাহ সা.-এর উপর ঈমান না আনলে সে ঈমানের একটি প্রধান বিষয় রিসালাতকে অস্বীকার করার কারণে কাফির হয়ে যাবে।
সৃতরাং যে ব্যক্তি এক আল্লাহর উপর ঈমান রাখে, কিন্তু মুহাম্মদ সা.-এর ওপর ঈমান রাখে না, তার জান্নাতে যাওয়ার চান্স ০ (জিরো) পার্সেন্ট অর্থাৎ তার জান্নাতে যাওয়ার কোনই চান্স নেই। অথচ তার জন্য ডা. জাকির নায়েক .০০১ পার্সেন্ট চান্স তৈরি করে দিলেন!

২. ডা. জাকির নায়েক বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা সবকিছু করতে পারেন না। যেমন, আল্লাহ লম্বা-খাটো লোক তৈরি করতে পারেন না। একইভাবে আল্লাহ একজন চিকন-মোটা লোক তৈরি করতে পারেন না। এ রকম হাজারো জিনিস আছে, আমি তালিকা দিতে পারি যা সর্বশক্তিমান খোদা করতে পারেন না। ...’
এরপর ডা. জাকির নায়েক বলেন, ‘কুরআনের কোথাও আল্লাহ বলেননি, তিনি সবকিছু করতে পারেন। বাস্তবে কুরআন বলে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’ এটি বলে না, খোদা সবকিছু করতে পারেন।’
ডা. জাকির নায়েক Is The Quran God's Word শীর্ষক সেমিনারে জনৈক মহিলার প্রশ্নের উত্তরে উক্ত বক্তব্য দেন। তার এ বক্তব্য তার লেকচার সংকলনে রয়েছে। তার রেফারেন্স হচ্ছে, ডা. জাকির নায়েক লেকচার সমগ্র, ভলিয়াম নং ২, পৃষ্ঠা নং ১৭৫ ॥ প্রকাশনায় : পিস পাবলিকেশন, কম্পিউটার মার্কেট, বাংলা বাজার-ঢাকা)

-ডা. জাকির নায়েক এ লেকচারে পবিত্র কুরআনের আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করে আল্লাহ তাআলা সবকিছু করতে পারেন-মহান আল্লাহর এ শাশ্বত মহান গুণকে অস্বীকার করেছেন। পবিত্র কুরআনের উল্লিখিত আয়াতের অর্থ সেটা নয় যা ডা. জাকির নায়েক বুঝিয়েছেন। বরং ওই আয়াতের অর্থ হচ্ছে- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম।’ (সুরা নুর, আয়াত নং ৪৫) এ আয়াতে মহান আল্লাহর গুণবাচক নাম ‘কাদীর’ রয়েছে- যা মহান আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম বুঝায়। আরবি অভিধানে এবং তাফসিরের কিতাবসমূহে এ শব্দকে এরূপেই বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
(প্রমাণ : আল-মিনহাজ, ১ম খ-, ১৯১ পৃষ্ঠা/ আল-আসমা’ লিল বাইহাকি, ২১ পৃষ্ঠা/ আল-মাকামুল আসনা, ২৩১ পৃষ্ঠা/ মাজমাউল বায়ান, ১ম খ-, ১৫৪ পৃষ্ঠা প্রভৃতি)

সুতরাংআল্লাহ তাআলা সবকিছু করতে সক্ষম। তাঁর মহান কুদরতের মধ্যে অক্ষমতা বা অপারগতা বলতে কিছু নেই। তিনি একই সাথে বিপরীতমুখী জিনিসও তৈরি করতে সক্ষম। যেমন, লম্বা-খাটো লোক সৃ’ি করতেও সক্ষম এবং চিকন-মোটা লোক সৃ’ি করতেও সক্ষম।

৩. ডা. জাকির নায়েক ‘নবি’কে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে দ্বিতীয়ভাগ সম্পর্কে বলেছেন- ‘নবি মানে এমন ব্যক্তি যিনি আল্লাহর পছন্দের এবং যিনি পবিত্র ও খাঁটি’। এরপর ডা. জাকির নায়েক বলেন- ‘ইসলামধর্মে এমন ৪জন মহিলা নবি আছেন, একজন বিবি মরিয়ম, একজন বিবি আছিয়া আ., এ ছাড়া অন্য নবিরা হলেন বিবি ফাতেমা ও বিবি খাদিজা আ.।’

ডা. জাকির নায়েক Women's Rights In Islam: Modernising or Outdated শীর্ষক সেমিনারের প্রশ্নোত্তর পর্বে উক্ত বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যটি তার লেকচার সংকলনে রয়েছে। তার রেফারেন্স হচ্ছে : ডা জাকির নায়েক লেকচার সমগ্র, ভলিয়াম নং ১, পৃষ্ঠা নং ৩৫৫ ॥ প্রকাশনায় : পিস পাবলিকেশন-ঢাকা।

-এ লেকচারে ডা. জাকির নায়েক প্রথমত ‘নবি’কে দু’ভাগ করে ইসলামের পরিভাষাকে পাল্টে দিয়েছেন, কারণ, ইসলামে নবি বলতে এক প্রকারই। নবির আর দ্বিতীয় কোনো প্রকার নেই। তারপর তিনি একদিকে চারজন মহিলার ‘নবি’ হওয়া দাবি করে পবিত্র কুরআনের খিলাফ কথা বলেছেন। কারণ, মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে শুধু পুরুষগণকে নবি রূপে প্রেরণের কথা বলেছেন। এ সম্পর্কে সূরাহ আম্বিয়ার ৭ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘(হে রাসূল!) আমি আপনার পূর্বে শুধু পুরুষগণকেই প্রেরণ করেছি- যাদের কাছে ওহি পাঠিয়েছি।’
তেমনি ডা. জাকির নায়েক রাসূলুল্লাহ সা.-এর পরে হযরত ফাতেমা রা. ও হযরত খাদিজা রা.-এর নবি হওয়ার কথা বলে রাসূলুল্লাহ সা.-এর খতমে নবুওয়াত বা শেষ নবি হওয়ার আকিদার পরিপন্থী বক্তব্য দিয়েছেন।

৪. ডা. জাকির নায়েক ‘আল্লাহর বাণী হওয়ার প্রমাণ’ সম্পর্কে বলেছেন- ‘কোন কিতাবটি প্রকৃতই আল্লাহর বাণী-তা জানতে হলে তাকে আধুনিক সায়েন্স ও টেকনোলজির দ্বারা যাচাই করতে হবে। যদি তা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে মিলে, তাহলে বুঝে নিবেন, এটা আল্লাহ তাআলার বাণী।’
ডা. জাকির নায়েক Religion In The Right Perspective শীর্ষক সেম্পোজিয়ামের প্রশ্নোত্তর পর্বে উক্ত বক্তব্য পেশ করেছেন। যা তার লেকচার সংকলনে রয়েছে। যার রেফারেন্স হচ্ছে : ডা. জাকির নায়েকের লেকচার সমগ্র, ভলিয়াম নং ৫, পৃষ্ঠা নং ১৬৪ ॥ প্রকাশনায় : পিস পাবলিকেশন-ঢাকা। এ ছাড়াও তার আইআরএফের পক্ষ থেকে প্রকাশিত উর্দূ গ্রন্থ ‘সায়েন্স আওর কুরআন’-এর ৪৩ নং পৃষ্ঠায় উক্ত বক্তব্য রয়েছে।

এ বক্তব্যে ডা. জাকির নায়েক মডার্ন টেকনোলজি বা আধুনিক বিজ্ঞানকে আল্লাহর বাণী যাচাই করার মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন। এটা তার ভুল থিউরি। বরং আল্লাহর বাণী বিজ্ঞানের দ্বারা যাচাইয়ের উর্ধে। কারণ, মহান আল্লাহর বাণী চিরশাশ্বত ও চিরন্তন, যা কখনো ভুল হতে পারে না। পক্ষান্তরে বিজ্ঞান হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্কের চিন্তা-গবেষণার ফসল-যা ভুলও হতে পারে বা পরিবর্তনও হতে পারে।
এমনি করে বহু বিষয়ে ডা. জাকির নায়েক ভুল তথ্য প্রচার করেছেন। সংক্ষেপ করার জন্য যার কিছু বিষয় সম্পর্কে এবার শুধু টাচ দিয়ে যাচ্ছি- যেমন, ডা. জাকির নায়েক বলেছেন-

*‘হুর শুধু নারী নয়, পুরুষ শ্রেণীরও হবে। জান্নাতে পুরুষরা পাবে ‘নারী হুর’ আর মহিলারা পাবে ‘পুরুষ হুর’।’
(দ্র’ব্য : ডা. জাকির নায়েক লেকচার সমগ্র, ভলিয়াম নং ২, পৃষ্ঠা নং ৬২৬ ॥ প্রকাশনায় : পিস পাবলিকেশন-ঢাকা)
* ‘সন্ত্রাসীর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে সমাজে মানুষকে ভয় দেখায়। একজন ডাকাত যদি কোন পুলিশকে দেখে ভয় পায়, তাহলে সেই পুলিশ ডাকাতের কাছে একজন সন্ত্রাসী। এভাবে প্রতিটি অসামাজিক কার্যকলাপে প্রত্যেকটি মুসলমানের এক একজন সন্ত্রাসী হওয়া উচিত।’
(দ্র’ব্য : ডা. জাকির নায়েক লেকচার সমগ্র, ভলিয়াম নং ২, পৃষ্ঠা নং ৬৪ ॥ প্রকাশনায় : পিস পাবলিকেশন-ঢাকা)
* ‘কুরআন শরীফ স্পর্শ করতে পবিত্র হওয়া বা উজু করা লাগবে না। বিনা উজুতে বা নাপাক অবস্থায় কুরআন শরীফ স্পর্শ করা যাবে।’
(দ্র’ব্য : ডা. জাকির নায়েক লেকচার সমগ্র, ভলিয়াম নং ২, পৃষ্ঠা নং ৬২৬ ॥ প্রকাশনায় : পিস পাবলিকেশন-ঢাকা)
* মেয়েরা হায়েজ বা মাসিক অবস্থায় কুরআন পড়তে পারবে।’
(দ্র’ব্য : ডা. জাকির নায়েকের ‘গোফতগো’ লাইভ প্রোগ্রাম)

ডা. জাকির নায়েকের এ রকম বহু ভুল বক্তব্য রয়েছে। এসব লেকচারের সবগুলোরই ভিডিওলিঙ্ক আমার কাছে আছে। সংক্ষেপ করার জন্য সেগুলো উল্লেখ করলাম না।

shamsabadi2

আওয়ার ইসলাম : আপনি জাকির নায়েকের ব্যাপারে যে তথ্যগুলো দিলেন, এসব কীভাবে পেলেন? আপনি জাকির নায়েকের উপর কতটুকু পড়াশুনা করেছেন?
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী : ইতোপূর্বে ডা. জাকির নায়েক সম্পর্কে আমার ধারণা ভালো ছিলো এবং তার বক্তৃতার আকর্ষণীয় স্টাইল দেখে অভিভূত হতাম। এর কিছুদিন পর কয়েকজন নির্ভরযোগ্য আলেমের মুখে যখন ডা. জাকির নায়েকের ভ্রান্তি সম্পর্কে অবগত হই, তখন মনস্থ করি, তার সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনে কিছু বলবো না। তাই সে সময় থেকেই তার লেকচার নিয়ে স্টাডি করি।
এক্ষেত্রে ডা. জাকির নায়েক সম্পর্কে জানতে তার প্রচারকেন্দ্র আইআরএফের পক্ষ থেকে তৈরিকৃত তার মূল লেকচারের ভিডিওসিডিগুলো সংগ্রহ করে সেগুলো শুনেছি। আবার ইউটিউবে আপলোড করা তার লেকচারগুলোও শুনেছি। সেই সাথে তার আইআরএফের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘খুতুবাতে জাকির নায়েক’ নামে তার লেকচার সংকলন পড়েছি এবং বাংলাদেশে তার অনুবাদ যা পিস পাবলিকেশন-বাংলাবাজার থেকে ‘ডা. জাকির নায়েকের লেকচার সমগ্র’ নামে বৃহদাকার ৬ ভলিয়মে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোও পড়েছি।

আওয়ার ইসলাম : আমরা যতটুকু দেখছি, সাধারণ মানুষ জাকির নায়েকের কথায় ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে, মানুষ উপকৃতও হচ্ছে, ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করছে। এটা কি ভালো দিক নয়?
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী : পূর্বেই বলেছি, ডা. জাকির নায়েকের উপস্থাপন পদ্ধতি চমৎকার ও আকর্ষণীয়। আর তার কথার যুক্তিগুলোও সাধারণ মানুষের জন্য চিত্তাকর্ষক। এ জন্যই সাধারণ মানুষ তার কথার দ্বারা খুব প্রভাবিত হন। কিন্তু সাধারণ মানুষ ইসলামের মূলনীতি ও কুরআন-হাদিস সম্পর্কে সম্যক অবগত নন। যার কারণে তারা তার বক্তব্যের আকিদাগত ও সুক্ষ্ম ভুলগুলো ধরতে পারেন না। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের জন্য জাকির নায়েকের ভুল তথ্য দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। আর বাস্তবেও তা-ই পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তাই এক্ষেত্রে মানুষের উপকৃত হওয়া বা ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করার বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়। সুতরাং এটাকে দ্বীনি খেদমত বলার কোন সুযোগ নেই।

আওয়ার ইসলাম : তার যদি এত ত্রুটি থাকে, তবে মানুষ এত প্রভাবিত হচ্ছে কেন? আর এটাও সত্য, তার কথায় প্রভাবিত হচ্ছে অনেক উচ্চ শিক্ষিত মানুষ? এর কারণ কী বলে মনে করেন?
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী : সাধারণত মানুষ বই পড়ার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয় তার সুখপাঠ্যতার কারণে। তেমনি বয়ান শুনার প্রতি আকৃষ্ট হয় তার শ্রুতিমধুরতার হিসেব করে। সেই সাথে পারিপার্শ্বিক আয়োজনও আকৃষ্ট করে। এক্ষেত্রে অনেকসময় বিষয়বস্তু লক্ষ্যণীয় হয় না। তদ্রুপ ডা. জাকির নায়েকের বাগ্মিতা, যুক্তিকৌশল ও সামগ্রিক আকর্ষণীয় ব্যবস্থাপনার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সাথে সেখানে নিয়মিত প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে মানুষের দ্বীনি জ্ঞানপিপাসা নিবারণের ব্যবস্থা করা হয়। এসবই মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। অপরদিকে তার অপূর্ব যুক্তিনির্ভর বাচনিকতায় নিউ জেনারেশন তাদের মনের খোরাক পায়। আর উচ্চশিক্ষিত যারা তার কথায় প্রভাবিত হয়, তারাও তো দ্বীনি জ্ঞানের ব্যাপারে অজ্ঞ। সুতরাং এক্ষেত্রে যদিও ডা. জাকির নায়েকের অনেক বক্তব্য সহিহ জ্ঞানসমৃদ্ধ না হয়, কিন্তু ইলমহীন সাধারণ মানুষ তার শুদ্ধাশুদ্ধির বিবেচনার অসাধ্য সাধনের চেয়ে তাদের বোধগম্য যুক্তিনির্ভরতাকেই অগ্রাধিকার দেয়। এভাবেই ডা. জাকির নায়েকের বক্তব্য তাদের মধ্যে বিস্তার লাভ করে।

ইসলামের সহিহ প্রচারক ও বিজ্ঞ ধারক-বাহক আলেমগণের এগিয়ে এসে সব রকম মিডিয়াকে আত্মস্থ করতে হবে এবং মানুষের দ্বীনি শিক্ষার চাহিদা পূরণ করে ডা. জাকির নায়েক থেকে তাদের অমুখাপেক্ষী করতে হবে। হক্কানি উলামায়ে কিরামের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে জনসাধারণের অংশগ্রহণে নিয়মিত যদি ডা. জাকির নায়েকের চেয়ে আকর্ষণীয় ইসলামি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় এবং সহিহভাবে দ্বীন প্রচারে সহিহ গ্লোবাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে সেই কনফারেন্সের লেকচারসমূহের প্রচারণার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে সেটাই এ ব্যাপারে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ হবে বলে আমি মনে করি।

আওয়ার ইসলাম : মানুষের মধ্যে ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে। মানুষ তো আর ফেরেশতা নয়। কেউ যদি চায় তার ভুলগুলো বাদ দিয়ে আমি শুধু ভালোটুকু গ্রহণ করবো, এমনটা মনে করার সুযোগ আছে কি?
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী : মানুষ ভুল করতে পাওে এ কথা ঠিক। তবে ভুলের শ্রেণিভেদ রয়েছে। যে ভুলের দ্বারা মানুষের ঈমান নষ্ট হতে পারে, এমন ধরনের ভুল গ্রাহ্য করার মতো নয়।
গোমরাহীমূলক ভুল না হলে তাকে পাশ কাটিয়ে সেখান থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ থাকে। যেমন, অনেক বইপত্রে ২/৪টি অনুবাদ বা উপস্থাপনায় সাধারণভাবে ভুল পরিলক্ষিত হলেও সে কারণে তা পড়তে নিষেধ করা হয় না, শুধু কেবল ভুলের ব্যাপারে সর্তক করা হয়।
কিন্তু ডা. জাকির নায়েকের ভুলের বিষয়গুলো দেখলে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন, তার অনেকগুলোই ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত। কাজেই সেগুলো উপেক্ষা করার মতো নয়। তাই এমতাবস্থায় যদি সাধারণ মানুষকে তার ভুলগুলো বাদ দিয়ে শুধু ভালোগুলো গ্রহণ করতে বলা হয়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে তারা তার ভাল-মন্দের ফরক করতে না পেরে তার কোন ঈমানপরিপন্থী বিষয়ে ভুলে আক্রান্ত হয়ে ঈমান হারাতে পারেন- যার কোনভাবেই ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়।

আওয়ার ইসলাম : জাকির নায়েক যেখানে কাজ করছেন, অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া, এখানে হক্কানি আলেমরা যাচ্ছেন না। সেখানে ধর্ম সম্পর্কে কেউ কথা বলছেন না। তিনি কথা বলছেন। মানুষ তার কথা শুনছে। গান-বাজনা না দেখে তার বয়ান শুনছে। এটাওতো এক দিক থেকে ভালো কাজ?
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী : একটি ভুল থেকে বাঁচার জন্য আরেকটি ভুল করার তো কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে করণীয় হলো, ইসলামের সহিহ প্রচারক ও বিজ্ঞ ধারক-বাহক আলেমগণের এগিয়ে এসে সব রকম মিডিয়াকে আত্মস্থ করতে হবে এবং মানুষের দ্বীনি শিক্ষার চাহিদা পূরণ করে ডা. জাকির নায়েক থেকে তাদের অমুখাপেক্ষী করতে হবে। হক্কানি উলামায়ে কিরামের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে জনসাধারণের অংশগ্রহণে নিয়মিত যদি ডা. জাকির নায়েকের চেয়ে আকর্ষণীয় ইসলামি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় এবং সহিহভাবে দ্বীন প্রচারে সহিহ গ্লোবাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে সেই কনফারেন্সের লেকচারসমূহের প্রচারণার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে সেটাই এ ব্যাপারে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ হবে বলে আমি মনে করি।

আওয়ার ইসলাম : সাধারণ মানুষদের কাছে আপনার মেসেজ কী? কী করতে বলবেন? তার কথা শুনতে না করবেন? তাহলে মানুষ কার কথা শুনবে? মিডিয়ায় কোন বিকল্প আছে কি এই মুহূর্তে?
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী : সকল মুসলমানের কর্তব্য-সহিহভাবে দ্বীন হাসিল করা এবং সহিহভাবে দ্বীনের উপর আমল করা। এ জন্য সহিহ ধারার হক্কানি উলামা-মাশায়িখ থেকে সহিহ দ্বীনি হিদায়াত গ্রহণ করা তাদের কর্তব্য। আর সেই লক্ষ্যে তাদের কাছে সহিহভাবে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানো এবং ইসলামের সহিহ জ্ঞান তাদের প্রদান করা দ্বীনের কাণ্ডারি উলামায়ে কেরামের দ্বীনি জিম্মাাদারি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে এখন অনেকভাবে কাজ হচ্ছে। বিভিন্ন গ্লোবাল মিডিয়াও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মুসলমানগণ সেগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সহিহভাবে দ্বীন ও ঈমানের জ্ঞান ও আমলের শিক্ষা লাভ করতে পারেন।
এ ছাড়াও যুগচাহিদা পূরণে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে প্রথিতযশা আলেমদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। আর তাদের উক্ত দ্বীনি দাওয়াহর যথোপযোগী ব্যবস্থাপনা আনজাম দানের সহায়তায় সামর্থবান মুসলমানদের এগিয়ে আাসা আবশ্যক। তারা সেই কর্তব্য পালনে অগ্রসর হলে, আশা করি উলামায়ে কিরামের জন্য ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াসহ যুগোপযোগীভাবে সব মিডিয়ায় দ্বীনের দাওয়াতের মহান দায়িত্ব পালন করা সহজ হবে।

ধমের্র দিক দিয়ে বিভ্রান্তি হলো, তার কুরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা। আর সমাজের দিক দিয়ে বিভ্রান্তি হলো,  জাকির নায়েক মৌলবাদ,  সন্ত্রাসবাদ ও জিহাদ এই তিনটাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। যার কারণে চরমপন্থিরা তার কথার মাধ্যমে প্রশ্রয় পেয়েছে। যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এজন্য পিস টিভি বন্ধ থাকাটা আমরা ভালোই মনে করি।

আওয়ার ইসলাম : সাম্প্রতিক গুলশান ট্রাজেডিকে কেন্দ্র করে সরকার জাকির নায়েকের পিস টিভি বন্ধ করে দিয়েছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী : আমাদের লেখার উদ্দেশ্য ছিল জাকির নায়েকের সংশোধন করা, ইসলামের দাওয়াতকে বন্ধ করা নয়। কিন্তু তিনি সংশোধন হননি। তাই সরকার যে জাকির নায়েকের পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করার ব্যবস্থা করেছে সে জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। এর মাধ্যমে মানুষ ধর্মের দিক দিয়ে ও সমাজের দিক দিয়ে জাকির নায়েকের বিভ্রান্তি থেকে বাচঁতে পারবে। ধমের্র দিক দিয়ে বিভ্রান্তি হলো, তার কুরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা। আর সমাজের দিক দিয়ে বিভ্রান্তি হলো,  জাকির নায়েক মৌলবাদ,  সন্ত্রাসবাদ ও জিহাদ এই তিনটাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। যার কারণে চরমপন্থিরা তার কথার মাধ্যমে প্রশ্রয় পেয়েছে। যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এজন্য পিস টিভি বন্ধ থাকাটা আমরা ভালোই মনে করি।

আর ভবিষতে তিনি যদি তাওবা করেন, নিজেকে শুধরে নেন, তাহলে আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাবো যেন পিস টিভি খুলে দিয়ে জাকির নায়েককে ইসলামের দাওয়াত প্রচারের সুযোগ করে দেয়।

আওয়ার ইসলাম : আলেমদের বিরোধিতা আর সরকারের বিরোধিতার অর্থ কি এক? আলেম উলামারা আকিদাগত কারণে জাকির নায়েকের সমালোচনা করছেন, আর সরকার পিস টিভি বন্ধ করেছে ভিন্ন করণে, তাহলে কিভাবে আপনি এর সমর্থন করেন?
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী : আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ আদর্শ নারীর মাধ্যমে তার ব্যাপারে লেখালেখি করছি। সেখানে সরকার যে উদ্দেশ্যে পিস টিভি বন্ধ করেছে এই ব্যাপারটাও ছিল। আমরা আরো অনেক দিন আগেই এই শংকা প্রকাশ করেছিলাম যে, জাকির নায়েকের বক্তব্যের মাধ্যমে চরমপন্থিরা ভুল মেসেজ পাবে। সন্ত্রাসবাদ উস্কে যাবে। বোমা মারা, মানুষ হত্যা করা এগুলো জাকির নায়েকের উদ্দেশ্য না থাকলেও তার কথার দ্বারা মানুষ ভুল বুঝবে। যারা সন্ত্রাসবাদ লালন করতে চায় তাদের কাছে ভুল মেসেজ যাবে এই শংকার কথা আমরা বলেছি। এখন আমাদের সেই শংকাই বাস্তবে পরিণত হচ্ছে।

আওয়ার ইসলাম : বর্তমান উলামায়ে কেরামের অনেকেই পিস টিভি বন্ধ করে দেয়ার সমালোচনা করছেন। তারা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সর্বপরি ইসলামের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছেন। এব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী : আমরা ইতিপূর্বে জাকির নায়েকের সমালোচনা করেছি। আর এখন পিস টিভি বন্ধের কারণে নাখোশ হলে,  সরকারের সমালোচনা করলে আমাদের কাজের মধ্যে বৈপরিত্য এসে যাবে। সেটা হবে দ্বিমুখিতা
আর সরকারের উদ্দেশ্য যদি ইসলামের উপর আঘাত করাই থাকে তাহলে পিস টিভি বন্ধ করা ছাড়াও করতে পারে। সরকারের কাছে আরও অনেক পথ আছে। তাই পিস টিভিকে সমর্থনের জন্য এটা অজুহাত হতে পারে না।

আওয়ার ইসলাম : আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী : আপনাকেও ধন্যবাদ এবং আওয়ার ইসলাম কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই সময়োপযোগী এ বিষয়ে আলোচনা নির্বাচন করার জন্য। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন। আমিন।

আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ