বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


ধারাবাহিক উপন্যাস : অশুদ্ধ পুরুষ (৪)

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

monirমনির প্রধান : সকাল আটটা সাড়ে আটটায় রওশন আরা স্কুলে চলে গিয়েছেন। বাড়ি থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে তার স্কুল। স্কুলের নাম চৌধুরীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

নাজমুল হুদার মন মেজাজ সকাল থেকেই খারাপ। সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে তা বাড়ছে। সকালে চা খাওয়া হয়নি। কাজের মেয়েটার হাতের চা তিনি খেতে পারেন না। বাড়িতে মেয়েটা অনেকদিন। তবুও সব রান্না বান্না সে আয়ত্ত করতে পারেনি। সামান্য চা-টাও তার মনের মতো করে বানাতে পারে না। অতিরিক্ত টিভি দেখার নেশা। ক খ পড়তে পারে না মেয়ে, অথচ সারাদিন স্টার জলসা নিয়ে মেতে থাকে। প্রথমত দূর সম্পর্কের বোনের মেয়ে, তারপর আবার কাজের লোক আজকাল পাওয়াই যায় না। বিধায় জোতিকে খুব বেশি কিছু বলা হয় না। কখন কাজকর্ম ছেড়ে চলে যায় এই দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়।

লুবনার রাঁধার হাত মোটামুটি ভালো। চা বানালে মাঝেমধ্যে খেতে ভালো হয়। কখনো মুখেই দেয়া যায় না। বাড়িতে এককাপ চা না খেয়ে নাজমুল হুদা কখনো কলেজে যান না। রওশন আরা রাগ করে চা না বানিয়েই চলে গেছেন। নাজমুল হুদার মেজাজ একশর মধ্যে একশই তেঁতে রইল। চা খাওয়ার ব্যাপারটা ভোলার জন্য তিনি কতক্ষণ খবরের কাগজের পাতা উল্টাতলোগলনে । টিভি চালু করে টেনএ্যাকশনে খেলা দেখলেন কতক্ষণ। বই খুলে চার বছরের ছেলে নিশাদকে ‘অ তে অজগর, অজগরটি আসছে তেড়ে। আ তে আম, আমটি আমি খাব পেড়ে।’ পড়াবার চেষ্টাও করেছেন। তবুও এককাপ চার তেষ্টা ঘুরে ফিরে বার বার তার মনে হতে থাকে। চার তেষ্টা না মেটার যন্ত্রণায় যতোটা না দগ্ধ হন, তার চেয়ে বেশি জ্বলতে থাকেন রাগটাকে কারো ওপর ঝারতে না পারার যন্ত্রণায়।

তিন
মহল্লার চা দোকানদার জুলহাস মজার মানুষ। অপরিচিত যে কেউ তার সঙ্গে কথা বললে বোকা বনে যায়। কিছু ব্যাপার স্যাপার আছে জুলহাসের। সবসময় প্রকাশ করে না। । তবে অপরিচিত কাউকে একা পেলে তার আর রেহাই নইে। একদফা জুলহাস তাকে বোকা বানিয়ে ছাড়বেই। আরাফাতের যখন খুব মন খারাপ হয় তখন সে চলে যায় জুলহাসের চায়ের দোকানে। জুলহাস খুব ভালো চা বানায়। অন্যসব দোকানে প্রতিকাপ চা পাঁচ টাকা হলেও জুলহাসের দোকানে সাত টাকা। সাত টাকা দিয়ে আরাফাত সবসময় চা খায় না। বাড়তি দু’টাকার বিলাসিতা তো বটেই, পাঁচ টাকাতেও যখন তখন চা খাওয়া তার জন্য কঠিন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে মতের মিল নেই বলে হাত খরচা বাবদ বলতে গেলে কিছুই তার কাছে পাওয়া যায় না। দু’একটা টিউশনি করে যা টাকা আসে তা দিয়ে বাইশ তেইশ বছরের একটা ছেলের পকেট খরচা হয় না। মাসের বিশ বাইশ তারিখ আসতে না আসতেই তার পকেট হয়ে যায় ফাঁকা। এই বয়সের ছেলেদের ফাঁকা পকেটে ঘুরতে কী যে খারাপ লাগে তা বলার মতো নয়।

ফারহিকে আজ না পড়াতে পারায় আরাফাতের খারাপ লাগতে থাকে। ভেবে এই কারণেও মন খারাপ হয়, মেয়েটার ভেতর চাঁপা কোনো কষ্ট হয়তো আছে। তার হয়তো উচিত ছিল দু’একটা কৌতুক টৌতুক বলে মেয়েটাকে হাসিয়ে দিয়ে আসা। ফারহির রসবোধ ভালো। অল্পতেই হেসে ফেলে।
মেয়েটা বলছিল-পারিবারিক কোনো ব্যাপার। কী হতে পারে? ঝগড়াঝাটি? স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা? কিংবা মেয়েদের গায়ে? এসব আজকাল অধিকাংশ ফ্যামিলিতেই কমন ব্যাপার। নাকি এর চেয়েও মারাত্মক কিছু? মানুষ দিনদিন যতো সভ্য, আধুনিক হচ্ছে সুবিধা ভোগের পাশাপাশি সমস্যাও ততো বাড়ছে। প্রত্যেকটা মানুষের ভেতর হয়তো একটা অন্ধ গলি আছে। যেখানে অসভ্যতা, কিছু অন্যায় সবসময় লালিত হতে থাকে। এই আদিমতাকে মানুষ হয়তো কখনো পরাস্ত করতে পারবে না।

ক’দিন বাদে লুবনাদের ফাস্টইয়ার ফায়নাল পরীক্ষা। প্রিপারেশন নেওয়ার জন্য হাতে সময় বিশ-বাইশ দিন। সময়টা খুব বেশি নয়। বই নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকলে পরীক্ষায় ভালো কিছু হবে আশা করা যায়। স্যাররা প্রতিদিন কিছু না কিছু সাজেশান দিচ্ছেন। লুবনার মতিগতি দেখে মনে হয় সে মোটেও এ নিয়ে চিন্তা করছে না। কী হবে হোক এই জাতীয় একটা গা ছাড়া ভাব। শুধু লুবনা নয়, তাদের চার বান্ধবীর যে গ্রুপ, সবারই একই অবস্থা। জেরিন মাঝেমধ্যে মনে করিয়ে দেয়, এই আমরা যে খালি খালি ঘুরে বেড়াই, সামনে পরীক্ষা, কী হবে বলতো? কী হবে নিয়ে তার টেনশনই বোধহয় সবচেয়ে কম। চার বান্ধবীর কেউ একজন কলেজে না এলে সে-ই আগ বাড়িয়ে ফোন করে। বলে, আজ এলি না যে কলেজে? একটু আকটু আড্ডা না হলে কি পড়ায় মন বসে, না কলেজে আসতে ভালো লাগে?

তাদের আড্ডাকে অবশ্যই আড্ডা বলে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। কলেজের আশপাশের রাস্তায় অল্পস্বল্প হেঁটে বেড়ানোকে নিশ্চয়ই আড্ডা বলা যায় না। বেশির চেয়ে বেশি বাতাস খাওয়া শিরোনাম দেওয়া যায়।

লুবনা আজ কলেজ যায়নি। ঝাঁজালো রোদ বাইরে। আবহাওয়াটা হঠাৎকেমন পাল্টে গেছে। রাতে ভারি কুয়াশার মতো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামে। দিনে শুরু হয় সূর্যের অত্যাচার। এমন রোদ ওঠে যে সূর্যের নিচে মুহূর্তখানিক দাঁড়ালেই গা পুড়ে যাবার মতো হয়। রাত দিনের এই বিপরীতমূখী আবহাওয়ায় অসুখ-বিসুখেরা আসে দলবেঁধে। জ্বর, সর্দি, জণ্ডিস, ডায়রিয়া।

কলেজ থেকে আজ রাশেদের সঙ্গে ঘুরতে বেরুনোর কথা ছিল। বিজিবি ক্যাম্পে যে ক্যান্টিনটা আছে, খুব নাকি নতুন করে সাজিয়েছে। লেকের মাঝখানে জায়গায় জায়গায় হাফ দেয়ালের ছোট ছোট ঘর। সেই ঘরে দু’জন নারী-পুরুষের একান্ত কিছু সময়। ভাবতেই লুবনার কেমন রোমাঞ্চ অনুভব হয়। সে-ই একবার রোজার ঈদের পর বান্ধবীদের সঙ্গে লুবনা গিয়েছিল সেখানে। এরপর যাওয়া হয়নি আর।

অনেকদিন থেকেই রাশেদের সঙ্গে সেখানে যাবার ইচ্ছা লুবনার। অনেকটা দূরের পথ বলে সময় যেমন হয়ে ওঠেনি, মনের ভেতর সামান্য ভয়ও ছিল বৈকি। গভীর করে চেনার আগ পর্যন্ত কোনো ছেলের হাতে এতোটা পথের নিরাপত্তার ভার ছেড়ে দেয়া লুবনার কাছে উচিত বলে মনে হয়নি। এখন কি রাশেদকে গভীর করে চিনেছে সে? মাঝেমধ্যে মনে হয় ‘হ্যাঁ’, মাঝেমধ্যে মনে হয় ‘না’। একটা মানুষকে চেনা এতই কি সহজ ব্যাপার? মোটেও নয়। আমরা কেবল অভ্যস্ত হতে জানি। মানিয়ে নিতে জানি। কোনো কিছুর সঠিক রূপটি নির্ণয় করা দারুণ কঠিন। খুব বেশি যোগ্য না হলে এটি পারা যায় না। তবুও এতো দিনের পরিচয়ে একটা মানুষ সম্পর্কে আর কিছু না হোক কিঞ্চিৎ ধারণা তো পাওয়া যায়। লুবনার জীবনে রাশেদ প্রথম পুরুষ নয়। সেই অভিজ্ঞতায় তার মন বলে রাশেদ বেশ ভালো ছেলে। এছাড়াও লুবনা এগিয়েছে অনেক ধীর গতিতে। জীবনের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা আবার ফিরে আসুক নতুন করে এটা তার কাম্য নয়।

রাশেদের সঙ্গে ক্যান্টিনে যাবে কিনা এ নিয়ে গত কয়েকদিন সে ভেবেছে। একবার মনে হয়েছে না যাওয়াই ভলো। সবকিছু মিলিয়ে আবার মনে হয় চুন খেয়ে মুখ পুড়লে দই দেখেও ভয় হয়। কিন্তু সেই ভয়কে প্রশ্রয় দিলে জীবন থেমে যাবে। অথচ থেমে না থাকাই জীবনের ধর্ম। জীবন বহতা নদী। বিচিত্র বর্ণের অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে একে চলতে দেয়া উচিত। এতো যৌক্তিকভাবে গুছিয়ে চিন্তা করার পরেও লুবনার ভয় কাটে না। রাত যখন গভীর থেকে গভীর হয়, ভেজানো কপাট খুলে লুবনা খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়ায়। সমস্ত আকাশ ঝলমল করে তারাদের উপচে পড়া ভিড়ে। সেদিকে তাকিয়ে লুবনার বড় মনে পড়ে তাওফিকের কথা। যাকে নিয়ে সে একসময় দু’হাত ভরে স্বপ্ন এঁকেছিল।

হ্যালো, রাশেদ তুমি কোথায়?
তুমি কোথায় বল তো? আমি সেই কতক্ষণ অপেক্ষা করছি।
সরি, আমি আজ আসতে পারবো না।
কেন! শরীর খারাপ করেছে নাকি? কিছু হয়েছে!
রাশেদের কণ্ঠে একরকম ভয় ঝরে পড়ে। লুবনার কানে তা এড়ায় না। ভালো লাগে তার।
আসলে হয়েছে কি, দ্যাখো না বাইরে কী রোদ। ফ্যানের নিচে বসে আছি তবু দরদর ঘামছি। ঘামো শরীর নিয়ে কোথাও আমার যেতে ইচ্ছে করে না। আজ বাদ দাও। অন্য কোনোদিন। সরি, হ্যাঁ?
ঠিক আছে ঠিক আছে। অন্যদিন গেলে অন্যদিন যাবো। সমস্যা নেই। তুমি কি আজ দেখা করবে? বেরুবে বাড়ি থেকে? তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
এক থাপ্পর মারবো। দাঁত একটাও জায়গায় থাকবে না। ভাগ এখান থেকে।
কী আশ্চর্য! দেখতেই তো চেয়েছি। অন্য কিছু তো নয়। গালাগাল করছ কেন?
আরে তোমাকে বলিনি। ফারহিকে। সকাল থেকে মাথাটা খেয়ে ফেলছে। আমি কলেজ যাইনি বলে সেও স্কুলে যাবে না। এখন আমার দায়িত্ব হলো বাবাকে বোঝানো। যাতে কিছু না বলে ওকে। সরি, তুমি কিছু মনে করো না।
তোমাদের দু’বোনের ভেতর খুব মিল তাই না?
হ্যাঁ খুব মিল।
আচ্ছা লুবনা রাখছি কেমন?
আচ্ছা।

রাশেদের কোনোকিছু করার নেই। হাতে অফুরন্ত সময়। বাবা প্রচুর বিত্ত ভৈবব রেখে গেছেন। তার কিছুই করতে ভালো লাগে না। রাশেদের যে শিক্ষাগত যোগ্যতা তাতে অনায়াসে ভালো কোনো চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু চাকরিটাকে তার গোলামি লাগে। কোনো স্বাধীনতা নেই। আর ব্যবসা? ব্যবসা জেলখানার চাইতেও জঘন্য। গেইন করতে হলে শুধু অর্থ হলেই চলে না। প্রচুর মেধা এবং সময়ও ইনভেস্ট করতে হয়। তবে জীবনকে উপভোগ করার সময় কোথায়?

বাবার রেখে যাওয়া প্রচুর সম্পত্তি হলো পঞ্চগড় সদরে দু’তলা দুটো বাড়ি। দেড় বিঘার মতো জমি। টাউনে নিজস্ব জায়গায় ছয়টা দোকান। প্রায় পাঁচ কোটি টাকার সম্পদ। সে একা অংশীদার। জীবনে আর কি চাই। শুধু দোকান ভাড়া দিয়েই তার জীবন বাড়াবাড়ি স্বাচ্ছন্দে পার হয়ে যাবে।
আজ তার বন্ধুদের দলবেঁধে তেঁতুলিয়া ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল। সবাই গেছে। সে যায়নি। লুবনাকে নিয়ে ক্যান্টিনে যাবার কথা। এখন সে কি করবে? কিছুই করার নেই। সব বন্ধুরা তেঁতুলিয়ায়। সুজনকে একবার ফোন করে জানা দরকার সেও গেছে কি না। তার যাওয়া না যাওয়ার সম্ভাবনা ফিপটি ফিপটি। রাশেদ ফোন করে সুজনকে। নাম্বার বন্ধ।

চলবে...

আগের পর্ব : অশুদ্ধ পুরুষ ৩

আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /সাদী


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ