শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


ছড়ায় ছড়ায় ঈদ আনন্দ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

Eid-Mubarak-Calligraphy-imageআমিনুল ইসলাম হুসাইনী : ঈদ আমাদের ধর্মীয় উৎসব। সবচেয়ে বেশি অানন্দের উৎসব। এই অানন্দ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বমুসলিমের হৃদয় মিনারে। ছড়িয়ে পড়ে পত্র-পল্লবে, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে। ছড়িয়ে পড়ে কবি-সাহিত্যিকের গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ আর ছড়া-কবিতার ছন্দের বন্ধনে। তাইতো প্রতিবছর ঈদ এলেই মিডিয়াগুলোতে শুরু হয় ঈদ আনন্দ। বর্ণিল সে সব বৃহৎ কলেবরের ঈদ সংখ্যার বেশিরভাগ জায়গাই দখল করে রাখে আমাদের "ঈদ সাহিত্য।"

যত টুকু জানা যায়, বিশ শতকের গোরার দিকে বাংলা কবিতায় ঈদ নিয়ে লেখালেখির শুরু। ধারনা করা হয় সৈয়দ এমদাদ আলীর রচিত 'ঈদ' কবিতাটিই বাংলাভাষায় রচিত ঈদ বিষয়ক প্রথম কোনো কবিতা। যা সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে তাঁরই সম্পাদিত "মাসিক নবনূর" পত্রিকার ঈদ সংখ্যায়।

এর পর অনেকেই লিখেছেন। লিখেছেন কবি কায়কোবাদ,  গোলাম মোস্তফা,  বেগম সুফিয়া কামাল, কবি সিকান্দার আবুজাফর, সৈয়দ অালি হাসানসহ আরো অনকেই। তবে সবচেয়ে বেশি লিখেছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিশেষ করে তাঁর সেই অমর সংগীত - "ওমন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ" ছাড়া যেন ঈদ-আনন্দ পূর্ণতাই পায় না। সেই থেকে আজ অবধি ঈদকে নিয়ে লিখে যাচ্ছেন সমকালীন কবি সাহিত্যিকগণ। লিখছেন সাম্প্রতিক ছড়াকারগনও। তাঁদের সেই লিখনিই বলে দিচ্ছে বর্তমান ঈদের এপিঠ- ওপিঠ।

বর্তমানে যেসব ছড়াকাররা শুধুমাত্র পড়ার জন্যই ছড়া লিখেন না, বরং ছড়ার মাধ্যমে সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেন; এমন কয়েকজন ছড়াকারদের ছড়ার কথাই তুলে ধরছি "সাম্প্রতিক ছড়া-কবিতায় ঈদ" শিরোনামে।

শাওয়ালের এক চিলতে বাঁকা চাঁদ পশ্চিমাকাশে মুচকি হেসে জানিয়ে দেয় ঈদের আগমনী বারতা। কচিকাঁচা থেকে শুরু করে জোয়ান বুড়ো সবার মনেই তখন আনন্দের উল্লাস। বলতে গেলে কি এই চাঁদ রাতের আনন্দও যেন ঈদের চেয়ে কম নয়। এই আনন্দ সবচেয়ে বেশি দোলা দেয় শিশু-কিশোরদের নরম হৃদয়ে। চাঁদ রাত নিয়ে তাদের মধ্যে যেই আনন্দঘন অস্থির চিত্র ফুটে উঠে,  সেই দৃশ্যই ছন্দপল্লবে দৃশ্যায়ীত করেছেন এ সময়ের নন্দিত ছড়াকার জগলুল হায়দার তাঁর "চাঁদ রাতের ভাবনা"য়-

ইফতার শেষ করে
হুড়মুড় হুট
আজ ভাই সব্বার
একটাই রুট।
রুট মানে সিড়ি তাই
ভেঙে ভেঙে উঠি
কলোনির ছেলেপেলে
কি যে ছোটা ছুটি।

ছোটা ছুটি করে সব
হল্লায় নাচছে
অই অই অই কোণে

চাঁদ দেখা যাচ্ছে।

ঈদের চাঁদ মানে কচি মনে আনন্দের হুল্লোড়। ঈদ মানে ছোট্ট শিশুটির নতুন জামা আর নানা রকম খেলনা পাওয়ার বায়না। কিন্তু এমন ঈদ কি সবার জন্যই আসে? সব শিশুরাই কি ঈদের আনন্দে আনন্দিত হচ্ছে? সেসব শিশুদের কথাই ভাবুন, যাদের ঘুম ভাঙে বোমার বিস্ফোরনে। ঈদের দিনেও যেসব শিশুকে হারাতে হয় বাবার আদর আর মায়ের উষ্ণ কোল। তাদের মনের আকাশে ঈদের বাঁকা চাঁদ যেন ওইসব জুলুমবাজদের কামান বোঝাই করা কোনো নৌকা।
'টুপির ভেতরের ছড়া' গ্রন্থের ছড়াকার, জনপ্রিয় ছড়াশিল্পী মুনীরুল ইসলাম সেইসব শিশুদের হৃদয়ের অব্যক্ত কথা তাঁর দরদী কলম যেভাবে তুলে ধরেছেন "যুদ্ধ দেশের ঈদ"এর চিত্র-

তোমরা সবাই ঈদের চানে
শেষ বিকেলের মিলাদ মানে
রকম রকম খেলনা জামার
নতুন আমেঝ পাও,
যুদ্ধ দেশের শিশুর মনে
ভীতি থাকে প্রতি ক্ষণে
ওই বাঁকা চাঁদ জুলুমবাজের
কামান বোঝাই নাউ।
তোমরা সুখের সাগর বেয়ে
ঈদের পায়েশ ফিরনী খেয়ে
স্মৃতির ঝাঁপি উল্টে দিতে
খুঁজ মায়ের কোল,
ওরা শোকের অশ্রু ঢেলে
উপোষ পাখির ডানা মেলে
বাবা মায়র অাদর বিহীন
কষ্টেতে খায় দোল।

একই চিত্র তুলে ধরেছেন নন্দিত ছড়াকার আবিদ আজমও তাঁর ছড়া "ঈদের চাঁদও কাঁদছে"- এর মধ্যে। তিনি ঈদের সুখকে স্বার্থপরের মতো একাই বরণ করতে পারছন না। তিনি লিখেছেন,

ঈদের খুশি দাঁড়িয়ে আছে
এখন ঘরের বাইরে
কেমনে ধরি খুশিরও গান
তাইরে নাইরে নাইরে।
ঈদের চাঁদও উঠছে কেঁদে
গাজার শিশুর দুঃখে
তুমিই বলো কেমনে বরণ
করি ঈদের সুখকে?

এতো গেলো যুদ্ধ দেশের ঈদের চিত্র। আমাদের নিজেদের ছিন্নমূলদের চিত্রও কি কম বেদনার? জীবন যাদের কাটে রাস্তার ধারে। তাদের নিয়েও যেন ভাবার কেউ নেই। শূণ্য থালা হয় যাদের নিত্য সঙ্গী, তাদের কি আর ঈদের দিনে অন্য কিছুর বায়না সাজে?
ছড়াকার শামীম খান যুবরাজ সেই সব পথ শিশুদের দৃশ্যই যেন দৃশ্যায়ন করেছেন তার "সেই ছেলেটি" শিরোনামে,

যে ছেলেটি পথে ঘুমায়
রাত কেটে যায় মশার চুমায়
সুখের নাগাল পায় না,
তার কি আছে ঈদের দিনে
নতুন জামার বায়না?

যে ছেলেটির ক্ষুধার জ্বালা
যার হাতে রয় শূণ্য থালা
দু'মুঠো ভাত পায় না,
তার কি আছে ঈদের দিনে
ঈদি পাওয়ার বায়না?

একই সুর বাজে ছড়াকার মির্জ মুহাম্মদ নূরুন্নবী নূরের "ঈদের জামাত" ছড়ার অন্তেও। তিনি ওইসব ছিন্নমূলদের হয়ে লিখেছেন,

বস্তিবাসীর টোকাই আমি
পাই না খাবার ভাত
পথে ঘাটে কাগজ কুড়াই
পথেই কাটে রাত।
আসছে ঈদে মনের ক্ষিধে
রূপের চাওয়া জামা
একটি ভালো কাপড় ওগো
দেয় না কোনো মামা।
এমনি ছেড়া জামা পড়েই
সারি ঈদের জামাত
আমরা কিগো মানুষ জাতি
নাকি অন্য জাত?
ঈদ মানেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাওয়া। তাই
ঈদ এলেই বোঝাই বোঝাই গাড়ির বহর ছুটে চলে গ্রামের উদ্দেশ্যে। জীবিকার তাগিদে গ্রাম থেকে ছুটে আসা মানুষগুলো নাড়ির টানে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। সারা বছর শহরে থাকলেও ঈদে যেন তাদের বাড়ি ফেরা চাইই চাই। নতুবা ঈদের শত আনন্দও যেন তাদের কাছে পানসে। এ সময়ের জাগ্রত ছড়াকার জিসান মেহবুব সে কথাই বলছেন তার "ফিরবো ঈদে বাড়ি"তে-

ছয়টা বছর হয়নি যাওয়া
ফিরবো এবার ঈদে
মায়ের হাতের রান্না খাবো
পেটে দারুণ ক্ষিদে।
গ্রাম ছাড়াতো ঈদের মজা
পানসে কেমন লাগে
শহর মানেই খাপ ছাড়া দিন
বিষন্ন মন জাগে।

একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ আসে মানব হৃদয়ে আনন্দের হিল্লোল নিয়ে। আচ্ছা! যে ঈদ নীল আকাশের ওপার থেকে নিয়ে আসে এত আনন্দ উচ্ছ্বাস, তবে কি নাম সে ঈদের? ডা. সাবিলা ইয়াসমিন মিতা তাই যেন বলতে চাচ্ছেন তাঁর "ঈদুল ফিতর ঈদ"ছড়ায়,

ঐযে দেখ চাঁদের খুশি
নীল আকাশের দেশে
যে খুশিটা চার দিকেতে
আসছে ভেসে ভেসে।
সাগর পাহাড় ঝর্ণা নদী
সবাই আত্মভোলা
বলতে পারো কোন খুশিটা
দিচ্ছে এত দোলা?
সে খুশিটা খোকা খুকুর
কারছে চোখের নীদ
সেই খুশিটাই আজকে হলো
ঈদুল ফিতর ঈদ।

ঈদকেতো জানা হলো কিন্তু..! কিন্তু ঈদের বাড়ি কোথায় তা তো জানা হলো না! আচ্ছা ঈদ কি বাড়িতে একাই থাকে?
এমনই কিছু মজার মাজার প্রশ্নে মজার মানুষ আহমেদ জাকির সাজিয়েছেন তাঁর মজার ছড়া "ঈদের বাড়ি কোথায়"-

ঈদের বাড়ি কোথায় বলো
কাদের বাড়ির পাশে?
ঈদ কি বাড়ি একাই থাকে
একাই সাজে রঙিন সাজে
সেজেগুজে বছর ঘুরে
রঙিন হয়ে আসে।
ঈদটা তবে লক্ষী অনেক
প্রতিবছর এসে এসে
সবাইকে সে হাসায়
আচ্ছা সবাই তৈরি থেকো
ঠিকানাটা পাবার পরে
যাবো ঈদের বাসায়।

ছড়া সাহিত্যের অত্যন্ত তীক্ষ্ম কটি মাধ্যম। মানুষের মনের গভীরে ছড়া যতটা সহজে প্রবেশ করে সাহিত্যের অন্য কোনো মাধ্যম ততোটা পারে কি না যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ছড়ায় যেমন আনন্দের খৈ ফোটে তেমনি মানুষের চরম দুর্ভোগের কথাও উঠে আসে। এমনই একটি ছড়ায়
এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে সাধারণ মধ্যবিত্তদের কষ্ট তুলে ধরেন বিশিষ্ট ছড়াকার খালেক বিন জয়েন উদ্দীন "সন্দেশ" শিরোনামে,

ঈদের খুশি পাই না খুঁজে
শহর গ্রাম বন্দরে
দৈন্যদশায় চালের বাজার
হাজার টাকার মণ দরে।
ঈদের খুশি পাই না খুঁজে
ছিন্ন তালির পরণে
শূণ্যি হাড়ি চুলোয় পোড়ে
দুঃখ ব্যথার ক্ষরণে।

তারপরও আমরা স্বপ্ন দেখি নতুন দিনের, নতুন ভোরের। যে ভোরের খুশিতে সকল হিংসা বিভেদ ভুলে, যুদ্ধ-বিগ্রহ, বাধা- বিপত্তি দূর করে বিশ্বমুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আরো সুদৃঢ় করে তুলবে সাম্যমৈত্রীর বন্ধনন। সেই ভোর হোক ঈদের ভোর। ঈদ আসুক খুশির বারতা নিয়ে নীলাকাশের ওপার থেকে। সেই ঈদ হোক হাজার বছরের আগের ঈদের মতোই। সবশেষে সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বরেণ্য ছড়াকার হাসান রাউফুন এর "ঈদ মুবারক" দিয়েই সমাপ্তি টানছি,

হাজার বছর আগেও ছিল
এখনও আছে-
জীর্ণ -উঁচু মধ্য-নিচু
কিংবা ঘরের কোণে কোণে

ছোট্ট বড় সবার মনে
যেমন ছিল তারচে বেশি বিশ্বজনে।
নতুন অতীত পোক্ত করে
সবার খুশির ভীত
ঈদ মুবারক ঈদ
ঈদ মুবারক ঈদ।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ