শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


বিদেশ বিভূঁইয়ে ইসলাম : আমি ও আমরা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

franceএম মাহমুদ খান : সময়টা ছিলো ২০০২ সাল। রমজান মাস। সবেমাত্র ইউনিভার্সিটির পাঠ গুটিয়েছি। জীবিকার তাগিদে বিদেশে পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্যে। প্রস্তুতিও শেষ। এখন শুধু যাবার পালা। শেষ মুহূর্তে মায়ের আকুতি, ‘ঈদের মাত্র আর এক সপ্তাহ বাকি। ঈদটা করে গেলে হয় না বাবা?

মা, ভাই -বোন, ভাতিজা-ভাগ্নিদের আকুতি। বিয়োগ বেদনার কান্না। কিন্তু, আমি নিরুপায়। বিমানের টিকেট কনফার্ম। রাতেই ফ্লাইট। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। মনটাকে শক্ত করলাম।

মাগরিবের আজান হলো। বাসায় আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ইফতার করলাম। মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। বাসায় এসে সর্বশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। পাসপোর্ট, টিকেট, লাগেজ ইত্যাদি গোছালাম।

এশার সময় হলো। মসজিদে গেলাম। নামাজ শেষ করলাম। বাসায় আসলাম।

চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে আপন নীড় ছাড়লাম। কষ্টে হৃদয়টা ফেটে যাচ্ছিলো। তারপরও, ছাড়তে হবে। মায়ের কোল ছেড়ে দূর দেশে পাড়ি জমাতে হবে।

রওয়ানা দিলাম। একপর্যায়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। তারপর বিমান বন্দরের নানান ফর্মালিটি শেষ করলাম। বিমানে চড়লাম। আসন গ্রহণ করলাম। কিছুক্ষণ পরেই বিমান উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিলো।

বিমান আকাশে উড়ছে। সাথে আমার মনটাও পুড়ছে। বিমানের জানালা দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিলো। যদি আর কোনোদিনও দেখা না হয়। এই আশংকায়। তবে, মনে এ আশাটুকুও ছিলো, ‘আবার আসবো ফিরে, এই বাংলার তীরে।’ জানালা দিয়ে তাকালাম। রাতের ঘোর  অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। চোখ দুটো বন্ধ করলাম। আসনে হেলান দিলাম।

গভীর রাত। ক্লান্ত শরীর। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, টেরও পাইনি। হঠাৎ মনে হলো, কে যেনো আমায় ডাকছে। ‘স্যার! স্যার!! আপনি কি রোজা রাখবেন? সেহেরির সময় হয়েছে।’ চোখ মেললাম। দেখলাম, বিমানের কর্মকর্তা। বললাম, ‘জি! রাখবো।’

খাবার পরিবেশিত হলো। বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে। মনে মনে ভাবলাম, ‘আকাশ ভ্রমণে সেহেরি! মহান আল্লাহর দরবারে অশেষ শুকরিয়া। কৃতজ্ঞতা।’

দুবাই এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। এখানে দীর্ঘ ১১ ঘন্টার যাত্রা বিরতি হলো। এয়ারপোর্টের ট্রানজিট লাউঞ্জে খেজুর, জুস আর কেক দিয়ে অতি অল্প সময়ে ইফতার করলাম।

পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য ছুটলাম। নির্ধারিত ইথিওপিয়ান এর বিমানে চড়লাম। একপর্যায়ে আফ্রিকার ছোট্ট একটি দেশ বেনিন এর রাজধানী লোমে অবতরণ করলাম। অথচ, আমাদের গন্তব্যস্থল ছিলো ইউরোপের দেশ ফ্রান্সে।

ভিসা জটিলতায় বেনিনে ৪ দিন অবস্থানের বদলে অবস্থান করতে হলো দীর্ঘ ১১ মাস! অমানবিক কষ্টগুলো সাদরে গ্রহণ করতে হচ্ছিলো নিরুপায় হয়ে। অকাতরে। তারপরও, নিয়মিত নামাজ, রোজা আদায় করতে থাকি। আমি একা নই! আমার সাথে আরো বারো জন!

যথারীতি ঈদ চলে আসে। দেশটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত। এখানে সল্প সংখ্যক মুসলিমের বসবাস। যখন এ বিষয়টি নিশ্চিত জানতে পারলাম, তখন আমরা ঈদের নামাজের জন্যে ঈদগাহ খোঁজা শুরু করলাম। একপর্যায়ে এক খ্রিস্টানের সহায়তায় ঈদগাহের সন্ধান পেলাম।

ঈদের দিন। আফ্রিকার বেনিনে-এর ঈদগাহে গেলাম। নামাজ আদায় করলাম। সবার জন্যে দোয়া করলাম। কেঁদে কেঁদে। প্রাণভরে।

নামাজ শেষ। ফোন ফ্যাক্সের দোকানে গেলাম। 'মা'- কে ফোন করলাম। মা ফোন রিসিভ করলেন। তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। আজ ঈদের দিন, তাই ঈদের নামাজ পড়তে পেরেছি কিনা; মা জানতে চাইলেন। কী খেয়েছি, তাও জিজ্ঞেস করলেন। তিনি কাঁদছেন। অঝোরে। তাঁর কান্না থামছেই না। মাকে সান্ত্বনা দিলাম। পায়েস, পোলাও-মুরগির গোস্ত, রান্নার কথা বললাম। তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। মা বলতে লাগলেন, বাসায় কত কিছু রান্না করেছি। তুই তো খেতে পারছিস না। আমি আর কান্না ধরে রাখতে  পারছিলাম না। চোখে অশ্রুর বান ডাকলো। কষ্টের বাঁধ ভেঙ্গে দিয়ে, অঝোরে গাল বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করলো।

দেশের সবার কথা খুব মনে পড়তে লাগলো। ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাগ্নিদের কথা। ঈদের দিন তাদর নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা। বাসায় আমন্ত্রিত অতিথিদের নিজের মত করে আপ্যায়িত করার কথা। ইত্যাদি আরো অনেক স্মৃতি। যা আজ আমার থেকে অনেক দূরে। বহুদূরে।

দেখতে দেখতে আফ্রিকার বেনিনে একটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো। আমাদের গন্তব্যস্থল ফ্রান্সে পৌঁছলাম। ঠিক রমজানের আগ মুহূর্তে। নামাজ-রোজা-তারাবি সবই চলছিলো। ঠিকমত। আলহামদু লিল্লাহ!

এখন ২০১৬ সাল। আমি ফ্রান্সে থাকি। এখানকার নাগরিক। এখানে অনেকগুলো বছর পার হলো। কেটে গেলো অনেকগুলো সময়।

ইউরোপের দেশ ফ্রান্সে খ্রিস্টান পরিবেশে কতশত বাধা-বিপত্তি। যেখানে হালাল-হারামের কোনো পার্থক্য নেই। নারী-পুরুষের ভেদাভেদ নেই। যেখানে সর্বত্রই বেহায়া আর বেলেল্লাপনার ছড়াছড়ি। এতো প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও, এখানে গড়ে উঠছে দুইটি বাংলাদেশ কমিউনিটি মসজিদসহ শত শত বিভিন্ন ভাষাভাষিদের মসজিদ। আর, দ্বীন শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। মসজিদগুলোতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত হচ্ছে। জুম্মার জামাত ও ঈদের জামাতে ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষণীয়। আমরা যারা প্রবাসী মুসলিম, তারা যে যার মত করে পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছি। ইসলাম ধর্মের অনুশাসন পালনের ক্ষেত্রে সাধ্যমত চেষ্টা করছি। কখনো মসজিদে গিয়ে, কখনোবা ঘরে বসে। সন্তানদের দ্বীনি শিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত  করার চেষ্টা করছি। আলহামদু লিল্লাহ!

বিদেশ বিভূঁইয়ে খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশে ইসলাম সমর্থিত বহু আনন্দ-উৎসব স্বাধীনভাবে পালনের ক্ষেত্রে আমরা বঞ্চিত। আমরা মনোকষ্টে আছি ঠিকই। কেউ বুঝুক বা না বুঝুক। কেউ জানুক বা না জানুক।

তবে, ইসলামের মূল অনুশাসন থেকে বিচ্যুত হচ্ছি না।

মহান আল্লাহর কাছে আর্তি, তিনি যেন আমাদের হেফাজত করেন। তাঁর দেয়া হুকুম-আহকাম পালনে পূর্ণ সাহায্য করেন। আমিন।

আল্লাহ তো মানুষের দিলের অবস্থা সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। আর, তিনিই তো বিচার দিবসের মালিক। মুসলিম জাতির ধর্ম তথা ইসলাম প্রতিটি মুসলিমের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই, সর্বত্রই তা পালনীয় অবশ্য কর্তব্য।

ইসলাম। শান্তির ধর্ম। মানবতার ধর্ম। একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ইসলাম আমাদের সাথে আগেও ছিলো, এখনো আছে, মৃত্যু অবধি থাকবে। ইনশাআল্লাহ্‌।

২৭ রু জন ভেরনেট, ৯৩১২০ লা কুরনভ, প্যারিস,  ফ্রান্স। muftymk@yahoo.fr

আওয়ার ইসরাম ২৪ ডটকম /আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ