|| মাহফুজ আহমাদ ||
নতুন শিক্ষাবর্ষের সূচনাতেই একজন সচেতন তালিবুলইলম এর উচিত, পুরো বছরের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা। এবছর আমার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার এবং কোন কোন বিশেষ যোগ্যতা অর্জন করা চাই; ইত্যাদি বিষয়গুলোর সুচিন্তিত একটি তালিকা তৈরি করে রাখা। সেই তালিকা ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। বরং স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এতে ভিন্নতা ও নতুনত্ব থাকাটাই মুনাসিব। খুব ভেবেচিন্তে, নিজের উসতায (তা'লিমি মুরব্বি অথবা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অভিভাবক) এর সঙ্গে পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো।
এখানে আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধির আলোকে কয়েকটি মাত্র পরামর্শ/প্রস্তাবনা পেশ করছি। সাধারণভাবে অধিকাংশ তালিবুলইলম সাথীর ক্ষেত্রে এগুলো প্রযোজ্য হওয়ার কথা ইনশাআল্লাহ।
এক. নিয়মিত মাকতাবায় (পাঠাগারে) সময় বিনিয়োগ করা। আপনি যে বিষয়ের কিতাবগুলো এই শিক্ষাবর্ষে পড়ছেন; সেই বিষয়ে আর কী কী রচনাকর্ম রয়েছে, কোনো ইমাম/আলেম/লেখক এবিষয়ে রচনা ও সংকলনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন, সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের ইতিহাস ইত্যাকার নানান প্রসঙ্গ জানবার একটা ফলপ্রসূ পদ্ধতি হলো, মাকতাবায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করা। নিজেকে ইসলামি উলূমের সেই বিশাল ঐতিহের সঙ্গে পরিচিতি করে তুলুন। এর উপকারিতা কেবল শিক্ষাজীবনেই নয়, কর্মজীবনেও আপনি অনুভব করতে পারবেন।
দুই. কোনো ইসলাহি মজলিসে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে চেষ্টা করুন। সপ্তাহে অথবা মাসে একদিন হলেও। নির্ভরযোগ্য হকপন্থী কোনো বুজুর্গের ইসলাহি মজলিসে যাতায়াত করলে ইলম অর্জনের পাশাপাশি আমলের জযবাও পয়দা হবে ইনশাআল্লাহ। আজকাল তো আমাদের তথ্যজ্ঞান কিছুটা সমৃদ্ধ হলেও আত্মশুদ্ধির অবস্থা খুবই নাজেহাল। ইলমের সঙ্গে যেন আমল-আদব-আখলাকের কোনো সামঞ্জস্যতাই নেই; আমাদের কারো কারো আচরণ থেকে এটাই অনুমিত হয়। সুতরাং বিশুদ্ধ নিয়তের সাথে বিশ্বস্ত কোনো আলেমের ইসলাহি মজলিসগুলোতে অংশগ্রহণের চেষ্টা করা দরকার।
তিন. বছরে অন্তত দুই-একটা ইলমি সফরের আয়োজন করুন। আগেকার যুগে তো 'রিহলাহ ইলমিয়্যাহ' ছাড়া কোনো তালিবুলইলম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী হওয়ার কল্পনা করা কঠিন ছিলো। তবে এখনও প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ আলেমদের সান্নিধ্যে যাওয়া উচিত। যেমন- মাদরাসার যে ছুটিগুলো (বিরতি) থাকে; সেই সময়গুলো কাজে লাগিয়ে এমন ইলমি সফর করে নেওয়া যায়। ইমাম নববি (নাওয়াওয়ি) রাহিমাহুল্লাহ বলেন, "শাস্ত্রজ্ঞ কোনো আলেমের সাহচর্যে এক মুহূর্ত কাটানো কয়েক ঘণ্টা বরং কয়েক দিন বই পাঠের চেয়েও অধিক ফলপ্রসূ প্রমাণিত হবে।' সুতরাং পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিন, এই বছর কয়েকজন বিজ্ঞ আলেমের সাক্ষাত ও সান্নিধ্যে যাবেন, কয়েকটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করবেন, ঐতিহাসিক কোনো স্থান ঘুরে দেখবেন ইত্যাদি।
চার. পাঠ্য তালিকাভুক্ত কিতাবগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রাসঙ্গিক ও সহযোগী (নোট/গাইড উদ্দেশ্য নয়) শাস্ত্রীয় কিতাবগুলোও যত্নসহকারে নিয়মিত অধ্যয়ন করতে থাকুন। মাকতাবায় আসা-যাওয়ার মাধ্যমে তো কিতাবের সঙ্গে পরিচিতি গড়ে উঠেছে। তবে কেবল পরিচিতি লাভ করেই ক্ষান্ত হওয়া সমীচীন নয়। বরং নির্বাচিত কিছু প্রয়োজনীয় কিতাব থেকে উপকৃত হওয়া দরকার। তাফসির, হাদিস, ফিকহ, আরবি ভাষা ও সাহিত্য, ইসলামি ইতিহাস, সমকালীন সমস্যা ও সেসবের সমাধান প্রভৃতি বিষয়ে আপনার তথ্যজ্ঞান আরও সমৃদ্ধ করতে এই পরিকল্পনা হাতে নিন।
পাঁচ. তালিবুলইলম সাথীদেরকে রোজনামচা লেখবার প্রতি মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ সাহেব হাফিযাহুল্লাহ বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে তাঁর একাধিক লেখা পাওয়া যায়। সেগুলো পড়ে প্রতিনিয়ত রোজনামচা লেখবার অভ্যাস গড়ে তোলা যায়। পাশাপাশি প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করবার প্রশিক্ষণ নেওয়া খুবই জরুরি।
লেখালেখির মাধ্যমে দ্বীনের বহুমুখী খেদমত করবার সুযোগ ও প্রয়োজন রয়েছে; নিঃসন্দেহে। তাছাড়া বক্তব্য উপস্থাপন করবার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা উচিত। (সম্ভবত) মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক সাহেব হাফিযাহুল্লাহর মন্তব্য অনুযায়ী একজন তালিবুলইলম এর জন্য এই তিনটি যোগ্যতা অর্জন করা উচিত। ক. যা পড়লেন তা নিজে নিজে বুঝতে পারবার যোগ্যতা অর্জন করা। খ. যা শিখলেন তা অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া; লেখনীর মাধ্যমে। গ. নিজের অর্জিত ইলম বিশ্লেষণ করে অপরের সামনে উপস্থাপন করতে সক্ষম হওয়া।
কেএল/