খ্রিষ্টীয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশে ইসলামের আগমন। ইসলাম আগমনের পর মনের মাধুরী মিশিয়ে এদেশে গড়ে ওঠে বিভিন্ন মুসলিম স্থাপনা। এ তালিকায় শীর্ষস্থান দখলকরা স্থাপত্যের মধ্যে শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা রহ. প্রতিষ্ঠিত সোনারগাঁওয়ের ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারসবাড়ি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। স্থাপনা দু’টি ঘুরে এসে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন এই দুই ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প লিখেছেন কাউসার লাবীব
উপমহাদেশের প্রথম হাদিস চর্চা কেন্দ্র:-
ইসলামি ইতিহাসে বাংলাদেশের রয়েছে গৌরবময় অধ্যায়। এখানেই গড়ে ওঠে উপমহাদেশের সর্বপ্রথম হাদিস চর্চা-গবেষণা কেন্দ্র। ১২৭০ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৬৬৮ হিজরি সন। শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা আল-বুখারি আদ-দেহলভি আল-হানাফি রহ. নামের এক আরবি বুজুর্গ ইসলামি শিক্ষার প্রসারে দিল্লি আসেন। তারপর সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহর অনুরোধে আসেন বাংলায়। প্রতিষ্ঠা করেন হাদিসচর্চার ঐতিহাসিক এই ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়টি।
শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা ছিলেন ইয়েমেনের অধিবাসী। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা তার সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর থেকে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে যে সকল অলি-আউলিয়া, পীর-দরবেশ, সুফি-সাধক, ধর্ম-প্রচারক ও আধ্যাত্মিক সাধক এসেছেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় এসে বর্তমান মোগরাপাড়া দরগাবাড়ী প্রাঙ্গণে একটি বৃহৎ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ও সমৃদ্ধ লাইব্রেরী গড়ে তোলেন। বর্তমানে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্যক্রম নেই এবং এর অবকাঠামোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
ঐতিহাসিকদের মতে, হাদিস ও ইসলামী আইনশাস্ত্রের পাশাপাশি তিনি ভেষজশাস্ত্র, গণিত, ভূগোল এবং রসায়নশাস্ত্রের একজন পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। ফলে তার প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরীটি ছিল বেশ আধুনিক ও সমৃদ্ধশালী। তার প্রতিষ্ঠিত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিলো উপমহাদেশের ইলমে হাদিসের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ। ধারনা করা হয়, তৎকালীন সময়ে দূর-দূরান্ত থেকে ইলম অর্জন করতে আসা এ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা ছিলো ১০ হাজারেরও বেশি। বিখ্যাত হাদিস বিশারদ ‘হাফেজ যাইনুদ্দীন ইরাকি’ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন বলেও মত দেন অনেক ইতিহাসবিদ।
শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা সোনারগাঁওয়ে দীর্ঘ ২৩ বছর হাদিসের পাঠ দেন। একটি খানকাও প্রতিষ্ঠা করেন। ‘মানজিলে মাকামাত’ নামে তাসাউফ সর্ম্পকে তার একটি লিখিত বই আছে।
এছাড়াও সোনারগাঁয়ের এ বিদ্যাপীঠে অবস্থানকালে তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ফিকাহ বিষয়ক যেসব বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেগুলোর সংকলনে ফার্সি ভাষায় রচিত ‘নামায়ে হক’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থের অস্তিত্বও পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে ১৮০টি কবিতা আছে। কেউ কেউ তা ‘মসনবী বনামে হক’ নামে অভিহিত করেছেন। গ্রন্থটি ১৮৮৫ সালে বোম্বাই থেকে এবং ১৯১৩ সালে কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। জানা যায়, ব্রিটিশ জাদুঘরের আর্কাইভ ভবনে শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার লিখিত পান্ডুলিপির অস্তিত্ব রক্ষিত আছে।
তার প্রতিষ্ঠিত এ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়টিই উপমহাদেশের ইতিহাসে হাদিসের আনুষ্ঠানিক পাঠদান শুরু করেছে। বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা তার লেখা, ‘রিহলায়ে ইবনে বতুতা’ গ্রন্থে এই ঐতিহাসিক বিদ্যাপীঠের কথা উল্লেখ করেন।
৭০০ হিজরী মোতাবেক ১৩০০ খ্রীস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইতিহাস জয় করা এই হাদিস বিশারদ শুয়ে আছেন সোনারগাঁওয়ের দরগাবাড়িতে।
১৯৮৪ সালে ইসলামী দার্শনিক ও চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. হিন্দুস্তান থেকে সোনারগাঁয়ে এসে শায়খের কবর জিয়ারত ও মুনাজাত করেন। মাজার থেকে অদূরে ভাগলপুর এলাকায় শায়খ শরফুদ্দিন রহ. এর স্মৃতি রক্ষার্থে ‘মাদরাসাতুশ শরফ আল ইসলামিয়া’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করেন, যা বর্তমানে সোনারগাঁয়ে ইসলামী শিক্ষার জ্যোতি ছড়াচ্ছে।
দারসবাড়ি: দেশের প্রাচীনতম ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়
সত্তর দশকের কথা। সবে দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন দেশের সোনাফলা মাটিতে চাষ করতে গেলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক কৃষক।
লাঙল দাবাতেই ইটের মতো শক্ত কী যেন লাগল। খুঁড়ে দেখলেন আবির রং-এর ইট। এক ইট। দুই ইট। তিন ইট। ইটের সঙ্গে ইট। চিন্তার ভাঁজ পড়ল কপালে। কী হতে পারে? ফিরে এসে পাড়ার মানুষকে জানালেন। এককান দু’কান করে খবর পেল স্থানীয় প্রশাসন।
খোঁড়া হলো মাটি। বেরিয়ে এলো ‘দারাসবাড়ি মসজিদ’। বাংলার প্রথম যুগের মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। আবারও প্রমাণিত হলো, বাংলার প্রতিটি ভাঁজে মিশে আছে কুরআনি আবেশ। ইসলামের ঘ্রাণ। নির্মল আলোর ছোঁয়া।’
মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল খ্রিষ্টাব্দ চতুর্দশ শতাব্দীতে। বাংলার আদি রাজধানী গৌড়ের ফিরোজপুরে। তখনকার শাসক সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহের আদেশে এটি নির্মাণ হয়। তখন এর নাম ছিল ফিরোজপুর মসজিদ। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ওই এলাকার শাসক নিযুক্ত হন সুলতান হোসেন শাহ।
মসজিদের অদূরে দারাসবাড়ি নির্মাণ করেন। আরবি দরস অর্থ পাঠ। তাই তৎকালীন শিক্ষাঙ্গনকে বলা হতো দারসবাড়ি বা দারাসবাড়ি। দারাসবাড়ির সুনাম, সুখ্যাতিতে এলাকার নামও পাল্টে যায়। হয় দারাসবাড়ি। এর সঙ্গে পাল্টে যায় মসজিদের নামও। পরিচিত হয় ‘দারাসবাড়ি মসজিদ’ নামে।
সমকালীন স্থাপত্যের বিচারে এর আয়োতন বেশ বড়ই বলা যায়। দৈর্ঘ্যে ৯৯ ফুট ৫ ইঞ্চি। প্রস্থে ৩৪ ফুট ৯ ইঞ্চি। সঙ্গে যুক্ত ১০ ফুট সাত ইঞ্চির অনন্য এক বারান্দা। পশ্চিমে কারুকার্য খচিত ৯টি মেহরাব। উত্তর, দক্ষিণে ৩টি করে জানালা।
নির্মাণশৈলী প্রমাণ করে এতে মহিলাদের জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থাও ছিল। কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে ছাদ। পূর্ণিমা রাতে চাঁদের আলোয়ে ভেতরটা ঝলমল করে। চারপাশের দেওয়ালও জৌলুস হারিয়ে অস্তিত্ব নিয়ে কোনোরকম টিকে আছে।
এ মসজিদটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষে চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থিত। কবিতার নদী মহানন্দার তীর ধরে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে। মসজিদের পাশে দিঘি। দিঘির এপারে মসজিদ। ওপারে মাদ্রাসা। এক সময় এ মসজিদের মিনার থেকে মোয়াজ্জিনের সুমধুর আজান ভেসে আসত। আকুল হতো মুমিনের প্রাণ। রবের ডাকে ছুটে আসত প্রাণের মসজিদে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যেত আমির, ফকির। ভুলে যেত ভেদাভেদ। পাপের গ্লানি মুছতে লুটিয়ে পড়ত প্রভুর পায়ে। জপন করত ‘সুবহানা রাব্বিআল আলা’।
দিঘির ওপারের মাদ্রাসা ছিল মুকুলে ভরা। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সন্তানরা এসে প্রাণ জুড়াত। ইমানি রং-এ রঙিন হতো। খুঁজে পেত স্রষ্টাপ্রেম। ধর্মের প্রতি ভালোবাসার টান। বিনিসুতার আবেগ। তাদের ওজুতে তরঙ্গায়িত হতো দিঘির সবুজ পানি। অবুঝ হাতে তুলে নিত পবিত্র কুরআন। ভোরের আলোর মিষ্টি ছোঁয়ায় ভেসে আসত মধুর আওয়াজ ‘ফাবিআয়্যি আলা-ই রব্বিকুমা তুকাজ্জিবান।’
আজ এর সবই অতীত। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে ছাদহীন দারাসবাড়ি মসজিদ। এখন আর বাজে না আজানের সুর। ভেসে আসে না কুরআনের ধ্বনি। শেষ রাতে কেউ আর বলে ওঠে না, ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।’ কালের আবর্তে এক সময়ের সজিব দুটি মুসলিম স্থাপত্য আজ অস্তিত্ব রক্ষার আকুতি করছে।
আমরা আশা নিয়েই বাঁচি। আশার মা গাঁলাথি। আশা রাখি মহানন্দার অপরূপ সৌন্দর্যে আবারও যোগ হবে দারাসবাড়ির আজানের ধ্বনি। উচ্চারিত হবে, ‘হাইয়া আলাস সালাহ’। এ শুনে কায়কোবাদের মতো কেউ হয়তো বলে উঠবে, ‘কে ওই শোনাল মোরে আজানের ধ্বনি। মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর, আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনি। কি মধুর আজানের ধ্বনি!
লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক
কেএল/