বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৯ শাওয়াল ১৪৪৫


ডক্টর আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ. একজন জগৎ কবির ক্যানভাস

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবুল ফাতাহ কাসেমী।।

নদীর দীর্ঘ শ্বাস থেকে নাকি কবিতার সৃষ্টি। যে কবি দীর্ঘ শ্বাস থেকে কবিতার জন্ম দেন তিনি আর যা-ই হোন সাধারণ কোন কবি নন বরং নন্দিত কবি স্বত্বা। তিনি জগৎ কবিতার স্রষ্টা। এমনই এক জগৎ কবির নাম ড. খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ।

বিনয় আমাদের গর্বের ধন। সে ধন অর্জন করেছেন তিনি। বিনয় আর বদান্যতার বিমূর্ত প্রতীক— এমন সজ্জন আমরা খুবই কম দেখেছি। আমাদের একালে।

আমাদের বাংলাদেশে ইসলাম, দেশ ও মানবতার প্রশ্নে ডক্টর আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর অনেক কারণেই প্রাসঙ্গিক। কর্মবীর এমন মানুষ মরেও হয়তো বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে শত বছর। কাল কে জানান দিয়ে যাবেন কর্মদক্ষতায় ইসলাম কে এগিয়ে নেয়ার সফল প্রয়াস। কর্মক্লান্ত এ মানুষটির শূন্যতা অনুভব হবে আরো বহু বছর। স্কিনের পর্দায় তার লেকচারের সানিন্দ্য উচ্চারণ আর বয়িত কথামালার বিদ্যুতছটা আজও কানে বাজে। বাজে থেকে থেকে। মনে হয়, তিনি এখনো জীবন্ত। জীবন্ত এমন জীবনকে হাজার বার স্যালুট।

তিনি চলে যাওয়ার আজ চার বছর। এমন সজ্জন, অমায়িক, ভারসাম্যপূর্ণ, মিষ্টভাষী আলেম জীবনে কম দেখেছি। আল্লাহ তাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন।

এগারোতে প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম তার। আওয়ার ইসলাম সম্পাদক আমাদের শ্রদ্ধাষ্পদেষু হুমায়ুন আইয়ুব ভাইয়ের মাধ্যমে, জামিআ শরইয়্যাহ মালিবাগের মুহাদ্দিস উস্তাদ মুহতারাম মুফতি হাফিজুদ্দীন স্যারের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। হুজুরের জামাআতুল আসআদ তখন ছিল রামপুরায় বউ বাজারের কাছে। দিনব্যাপী দাওয়াহ বিষয়ক কর্মশালায় স্যার ছিলেন প্রধান মেহমান। সে দিন তার ক্লাসের বিষয় ছিল দাওয়ার গুরুত্ব ও মাঠ পর্যায়ের কারগুজারি। আর তিনি যেহেতু মদিনা ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলাদেশে এসে অধ্যাপনার পাশাপাশি দাওয়াহ কাজে যুক্ত হোন এবং খ্রিষ্টান মিশনারীদের নিয়ে কাজ করতেন তাই সে দিন আমাদের কাছে তার উম্মতের প্রতি দরদকাতরতার বিষয়টি ফুটে উঠে নতুনভাবে। আবিষ্কার করি একজন নতুন আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর কে।

কথা ছিল, হুমায়ুন ভাইয়ের 'রাহমানি পয়গামের' জন্য একটি সাক্ষাৎকার নিব। কথানুযায়ী তিনি সময় দিতে রাজি হোন। মাদরাসার এ প্রোগ্রামের পর ইসলামিক টিভিতে তার একটি প্রোগ্রাম ছিল তাই তিনি আমাকে হাতে থাকা বিশ্রামের এক ঘণ্টা সময়টুকু দিয়ে দিলেন।

সাদা একটি প্রাইভেট চলছে বাংলামটরের দিকে। শহুরে যানজট আর প্রিয় কারো সংস্পর্শ উপভোগ করছি একসাথে। তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ কোনো স্মৃতি নেই; নেই কোন পরিচয়। স্বল্প সময়ের সামান্য কথাবার্তায় তার মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। মানুষকে এতটা সহজে কেউ আপন করে নিতে পারে এটা তাকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না।

আমি কয়েকটি প্রশ্ন আগেই প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। মদিনা থেকে পড়ে আসা কিছু ব্যক্তির বাংলাদেশে ফেতনা তৈরির প্রয়াস, দাওয়াহ, শিক্ষা, মিডিয়া, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গসহ নানা বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করলাম। অনর্গল তিনি জবাব দিয়ে গেলেন। তার চিন্তার গভীরতা, ভারসাম্যতা, কথা বলার ধরণ ও মিষ্টতা আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার প্রতি আকৃষ্ট করে রাখলো।

মিডিয়া সম্পর্কে আলেম-ওলামার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার পক্ষে মত দেন। যোগ্য ও ইলমি লোকদের টেলিভিশনে যাওয়ার ব্যাপারে তাগিদ করেন। বিশুদ্ধ আকিদার লোকেরা মিডিয়ায় না গেলে সেখানে বিদআতি ও ভ্রান্ত আকিদার লোকেরা বিশেষ করে আহলে হাদিস সম্প্রদায় দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করবে বলেও সতর্ক করেন। জাকির নায়েক সম্পর্কে বলেন, জাকির নায়েক সাহেব তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে থাকলেই ভালো, ফিকহি বিষয়াদিতে তার জড়ানো সমীচীন নয়। পিস টিভির আলোচক হওয়া সত্ত্বেও অনায়াসে কিছু বিষয়ে জাকির নায়েকের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি আমাকে সতর্ক করে বলেন, এদেশের কিছু ব্যক্তি দিয়ে মদিনা ইউনিভার্সিটি কে মাপা ঠিক হবে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমিই বাংলাদেশে প্রথম মদিনা ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসি। কই আমি তো মুক্ত চিন্তার নামে এসব নোংরামিতে জড়াই নি?

তার সাক্ষাৎকারে তিনি আলেমদের সতর্ক করে বলেন, দাওয়া কাজে আলেমগণ এগিয়ে না আসলে এজন্য চরম খেসারত দিতে হবে। পূর্ব তিমুর কিংবা দক্ষিণ সুদানের মতো অবস্থা এ দেশের অবস্থা হলে আমাদের হাতে আর সময় থাকবে না।

একবিংশশতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মিডিয়াতে আলেমদের অংশ গ্রহণের ব্যাপারে তাকিদ দেন। বর্তমানে যারা মিডিয়াতে মতানৈক্য মাসয়ালা বলে বারবার থুক্কু দেন তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, টেলিভিশনে মতানৈক্য বিষয় এড়িয়ে চলাই ভাল কারণ এর দ্বারা অনেক ফেতনা তৈরি হয়।

সাক্ষাতকার শেষে বিদায়ের আগে তিনি বললেন, কাজ করে যান এখন ভরপুর কাজের সময়। কাজের মানুষ থেমে থাকে না। থেমে থাকেনি।

টেলিভিশনে অনেকেই কথা বলেন, কিন্তু তার মতো এতো ভারসাম্যপূর্ণ কথা আর কারও কাছে আমরা পাইনি। কোনো কোনো চ্যানেলে তিনি সরাসরি প্রশ্নোত্তর দিতেন। জটিল জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতেন অতি সহজ করে, কোনো ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি ছাড়া। তাঁর আলোচনার সময় আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম একজন দা’য়ীর বাচনভঙ্গি এমনটাই হওয়ায় উচিত।

সব ধরনের, সব মত-পথের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় কেউ কেউ তাকে ভুল বুঝতো। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর সবার এটা অনুভব হচ্ছে, বহমান এ নষ্টালজিক সময়ে তার শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়। লেখক: মাদরাসা শিক্ষক

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ