বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


মা: একটি উদাস মনের প্রেমের আলপনা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

উবায়দুল্লাহ তাসনিম।।

আকাশটা আজ কেমন হেসে উঠেছে। আকাশ এঁকেছে সুখের আল্পনা। পুবাকাশের রক্তিম সূর্যটা নতুন দ্যােতনায় সেজেছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে চারদিক অজানা প্রেমের ছন্দে। মুণ্ডিত

আর ধূসর পাহাড়টাও কেন যেনো সবুজের সুখ ছড়িয়েছে চারপাশ। নতুন কিশলয় কেমন ছলছল খুশিতে মেতে উঠেছে।মেঠোপথের পাশ ঘেঁসা নদিটা নতুন আগমনে সুর তুলেছে। পাখ-পাখালি কার আগমনে যেনো মাতোয়ারা।

আমি এলাম নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে। চেয়ে দেখি, একজন দুঃখিনী মা নিথর পড়ে আছেন। আমার খুব কান্না পেলো। গগনবিদারী আর্তনাদে ফেটে তুলছি চারদিক। সবাই হাসছে। আনন্দ সংগীতে মুখরিত চারপাশ। আম্মু আমাকে বুকে আগলে নিলেন। কান্না থেমে গেলো আমার। ভালবাসার বিশাল বাহু দিয়ে আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাতের আঁধার নেমেছে ভুবনজুড়ে। কুয়াশায় ঢাকা চারদিক। কেউ জেগে নেই। মৃত্যুপুরির অবিকল দৃশ্য! দূরের ওই বনটায় দু'একটা দুঃখী শিয়াল কুঁ কুঁ কান্না করছে। আমি আর আম্মু জেগে। আমাদের চোখে ঘুম আসা হারাম। আমার যে অসুখ! প্রচন্ড জ্বরে কাতরাচ্ছি অসহায় আমি। আম্মু নিঃশব্দে কান্না করছেন। শ্রাবণের অবিশ্রান্ত ধারা নেমেছে তার দু'চোখ বেয়ে। আমি গলা ফেটে চিৎকার করছি।

আমি সেদিন ভাত খাইনি। আম্মুর মাথায় বিকাশ আকাশটা ভেঙ্গে পড়ল। প্রচন্ড জোরে ধমকালেন। আমার কিচ্ছুই মনে হয়নি। অবজ্ঞাভরে ভয়ঙ্কর ক'টা দাত বের করে খিলখিল হেসে দ্রুত পায়ে সিড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে এসেছি।

আমি একদিন পড়ে আছি পথের ধারে। ধূলোমলিন। ছিন্নবসন। অনেক্ষণ আগে ক্ষুধা পেয়েছিল, এখন আমি একেবারে শান্ত। নিথর। নিস্তরঙ্গ।চেনাজানা পৃথিবীর কেউ নেই আমার পাশে। আম্মা... আম্মা... আম্মা..। আম্মা দৌড়ে এলেন।

এক সকালে ঘাটে বাঁধা নৌকা। উত্তরের ঝেড়ো হাওয়ায় সারারাত নৌকাগুলি পানির উপর দাপাদাপি করে ক্লান্ত হয়ে কেমন ঘুমুচ্ছে। এখন, নিথর, নিস্তরঙ্গ। সূর্য উঁকি মেরে খানিকটা তেজস্বী। সকালের মিঠে রোদে এবার কেমন যেনো নতুনপ্রাণ ফিরে পাবে নৌকাগুলি। শিমুলতলায় পাখিদেরও আনাগোনা শুরু হয়েছে, রাখাল ছোকরা তিড়িংবিড়িং বাছুরগুলো নিয়ে ছুটছে সবুজের মাঠে।

এমন এক সকালে আব্বা মৃদু বকাঝকা করছেন, হুজুরের চোখে আঙ্গুল গেঁথে আমি চোরের মতো পালিয়ে এসে বাড়ি হাজির, আমাকে করুণ শাস্তি নিতে হবে, ইতিমধ্যে আব্বা অপরাধীর শাস্তি প্রদানের সব আয়োজনই সেরে ফেলেছেন, আমাকে এবার কে বাঁচাবে?

আম্মা দ্রুত রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন, আব্বুকে কি যে অভিমান, ছেলেটাকে ওরকম শাস্তি! এতো কঠোর শাস্তি ওর মতো হাল্কা গড়নের মানুষকে!

আম্মা সেদিন, আমার জন্য রহমত হয়ে আসলেন। শরতের আকাশে চাঁদের লুকোচুরি। ঝিকিমিকি তারকাদের মিটিমিটি হাসি প্রকৃতিকে মুগ্ধ করছে! অমন এক সন্ধ্যেয়

আমার আর মন্টুর এধার-ওধার ছুটে বেড়ানো, ঘরে ঘরে ঢুঁ মারা, ঠিক এরকম সময়টাতে বড় ভাইয়া এসে আমাকে আসামির মতো ধরে নিয়ে লৌহঘরে আবদ্ধ করা, এরপর, কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন। আমার বিচার শুরু হলে ঘরের সবাই আনন্দে আটখানা হয়ে রাজ্যির মজা লুটছে, অমনি আম্মাজান পাশের রুম থেকে ছুটে এসেছেন আমাকে উদ্ধার করতে। আম্মু...আম্মু...।

এক আকাশ আদর দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।

আমার পড়ার বয়স হয়েছে। শিক্ষার প্রয়োজনে দূরে কোথাও যাবার আয়োজন। শেষ বিদায়ে আম্মুর চোখে বিরহ উত্তাপের অশ্রু ঝরছে। আমি বিষাদ নিয়ে - পা এগুচ্ছে না মাদরাসার পথে- এরপরও, প্রচুর কষ্ট করে হাঁটছি। আম্মু দূরের পথ চেয়ে আছেন৷ লজ্জায়, অভিমানে কাতর আমি পেছন ফিরে তাকাই না, ওই যে এককালে আম্মুর কল্যাণ কামনাকে মনে হয়েছিল চরম নিষ্ঠুরতা!

রোজ বিকেলে খেলার মাঠে সবাই খেলছে, হইহুল্লোড়ে মেতে আছে সবাই, একটিমাত্র ছেলে মাঠের কোণে বিষণ্ণ মনে বসে আছে, সে আমি। ওই দূরদেশে সবুজ ঢাকা গ্রামের আড়ালে আমার বাড়ি। মন চায়, মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে উড়ে আম্মুর কোলে গিয়ে পড়ি। কিন্তু কাল যে বড়ো নিষ্ঠুর!

একদিন মধ্যাহ্নের খা খা রোদ্দুরের রাগী সূর্যটাকে আড়াল করে যখন ধূ ধূ প্রান্তর দিয়ে অবিরাম ছুটছিলাম, আমি তখন ভুলে গেছি দুঃখিনী মায়ের কথা, সাত সমুদ্র তের নদির ওপারে যেতেই অন্তঃপুরে বিরাট একটা ধাক্কা লাগে, আমি নিরালায় বসে কাঁদি, চোখের বাঁধ ভেঙ্গে অশ্রুর শ্রাবনধারা নেমে আসে। সেদিন বুকের দীর্ঘশ্বাস

ফেলে হৃদয়ে শান্তনা পেলাম।

প্যারিসের পথে পথে আমি যখন ভবঘুরে ছিলাম, আমাকে নিয়ে ওরা ঠাট্টা করে মনের আরাম খুঁজছিল। আমি যে মিসকিন বাঙ্গালি! আমি তখন ছিলাম, একলা, পাথেয়হীন, অসহায়, হঠাৎ আম্মুর কথাটা মনে করে ভরসার একটা আলো জ্বালিয়ে দিগ্বিদিক ছুটেছিলাম কালবৈশেখির তান্ডব চালিয়ে...আমার আম্মাজান তখন পাশে নেই, তিনি দূরদেশে বসে হারানো ছেলের শোকে বিলাপ করছেন।

চাদের আলো উপছে পড়ছে নদিতে। শান্ত নদী বহুকালের রীতির বুঁদবুঁদ মাথায় নিয়ে আপন বেগে ছুটে চলছে। কাশবনের উপর জোসনা নেমে এসেছে ধবধবে সাদা দুধের মতো! প্রকৃতি প্রিয়সীর মধুর হাসি হাসছে। ঠিক তখন, আম্মু শিমুল তলার জীর্ণ কুটিরে বসে আমাকে জীবন পথের পাথেয় দিলেন, বাবা! তুই বিপথে হাটিস নে, মানুষের সাথে তুই ভালো ব্যবহার করবি, মনে রাখিস, যে কোন বিপদে পড়ে আল্লাহকে ভুলে যাইসনে!

আরও যেনো কি একগাদা উপদেশ দিলেন। আমি এতোসব উপদেশ গ্রহণ করার মতো মানুষ না। নসিহতের ভীড় ঠেলে সামনে এগুনো অশান্ত আমার ধাতে নেই। তবুও কেমন যানি আজ তন্ময় হয়ে শুনছি। শুনতে বড়ো ইচ্ছে জেগেছিলো...

এরপর...

আমি একদিন পথ হারিয়ে অনেক দূরের পথে চলে এলাম। আম্মুর কথা (উপদেশমালা) একেবারেই ভুলে গেছি। আমি যেনো ছুটছি অনন্তকালের পথ ধরে। মহাকালের অগস্ত্যযাত্রায়। আম্মু না না বলে চিৎকার করে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলছেন। তবুও আমি...

শেষরাতের আসমানটা যখন পবিত্র আভা ছড়িয়ে যায়, সেখানে আমি দেখি আমার মায়ের নির্মল মুখচ্ছবি। ভোরের উত্তাল সমুদ্রের টেউগুলি যখন আছড়ে পড়ে আমার বুকে, ঝর্ণার কল্লোল আনন্দ সংগীতে বেজে চলে, সমুদ্রের ওই পাগলা ঢেউটা আমার মায়ের পলি দিয়ে যায় আমাকে, ঝর্ণার কল্লোলে শুনি আমার মায়ের সুর।

মহাকালের নিরন্তর যাত্রায় আমি যেদিন অস্তিত্ব হারাতে যাবো, সেদিনও আমি আমার আম্মার আঁচল ছাড়তে পারবো না।

লেখক: শিক্ষার্থী

ওআই/আবদুল্লাহ তামিম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ