শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


করোনায় ও মানবতার সেবায় এগিয়ে আল মারকাজুল ইসলামী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

‘সবসময় মানুষের জন্য’-এ স্লোগান নিয়ে ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয় আল মারকাজুল ইসলামী। একজন বিচক্ষণ আলেম প্রতিষ্ঠা করেন এই সহায়তা সংস্থা। মুফতি শহিদুল ইসলাম যিনি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে লাখ লাখ দরিদ্রের মুখে হাসি ফুটেয়েছে এ সংস্থা।

মানুষের সেবায় আল মারকাজুল ইসলামী অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানের ৩০টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। আল মারকাজুল ইসলাম অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসটি সম্পূর্ণ সেবামূলক সার্ভিস। গরিব ও অসহায় রোগীদের ক্ষেত্রে ফ্রী সার্ভিস দেওয়া হয়।

রোহিঙ্গাদের আর্তমানবতা সেবায় এগিয়ে এসেছিল আল মারকাজুল ইসলামী সংস্থা। মারা যাওয়া রোহিঙ্গাদের দাফন কাফন থেকে শুরু করে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের ফ্রি চিকিৎসা, ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, টিউবওয়েল স্থাপনসহ মহিলাদের গোসলখানা নির্মাণ করে দিয়েছে আল মাকাজুল ইসলাম সংস্থা। করোনার এ কঠিন মুহূর্তে মানবতার সেবায় সবার আগে এগিয়ে এসেছে সংস্থাটি। এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা ৩৫টি, গতকাল ৪টি আর আজ ৪টি লাশ দাফন করেছে তারা। এর মধ্যে হিন্দু লাশ ছিলো দু’টি। আওয়ার ইসলামের ডেপুটি এডিটর আবদুল্লাহ তামিম বিস্তারিত কথা বলেছেন মারকাজুল ইসলামীর নির্বাহী পরিচালক মাওলানা জুবায়ের হুসাইন কাসেমীর সঙ্গে।


আওয়ার ইসলাম: মানবসেবার লক্ষ্যে মারকাজুল ইসলামীর প্রতিষ্ঠা। আপনাদের লক্ষ্যে আপনারা কতটা সফল এবং আলেম হিসেবে মানবসেবাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

মাওলানা জুবায়ের হুসাইন কাসেমী: প্রথমত মুফতি শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে হক্কানি উলামায়ে কেরামের একটি টিম গঠন হয়। মারকাযুল ইসলামের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তাদের সাধ্য মতো মানুষের সেবা করে আসছে। আলহামদুলিল্লাহ মারকাজুল ইসলামীকে উলামায়ে কেরাম এক নামে চিনেন। এই মারকাজুল ইসলামী উলামায়ে কেরামের আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। এখনো মারকাজুল ইসলামী তাদের সাধ্যমতো সেবামূলক কর্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। মানবসেবাকে আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। আমরা রাসুল সা. এর আদর্শ হিসেবে মানবসেবায় নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছি।

আওয়ার ইসলাম: করোনার এ সময়ে মানবসেবায় আপনারা কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন।

মাওলানা জুবায়ের হুসাইন কাসেমী: কেরানীগঞ্জে নতুন একটি চক্ষু হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। করোনার শুরুতে সেখানে আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টাইন তৈরির পরিকল্পনা ছিল। পরে এলাকার টিএনও এটা দেখে আমাদের আশ্বাস দেন, কেরানীগঞ্জে কোয়ারানন্টেন করা হলে আপনাদেরটাই করা হবে। আমরা সে হিসেবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

পরে দেশে কয়েকজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। কিন্তু করোনার কারণে তাদের কাফন-দাফনে কেউ এগিয়ে আসে না। এমনকি আঞ্জুমানকে সরকারের পক্ষ থেকে আহ্বান করা হলে তারা নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করে। তখন ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে আমাদের ফোন করে লাশ গোসল করাবো কি না সে বিষয়ে জিজ্ঞাস করা হয়। পরে আমরা সবাই পরামর্শ করে এ বিষয়টিতে সম্মতি দিই। আমাদের কর্মীরাও প্রস্তুত হয়।

আওয়ার ইসলাম: করোনার প্রকোপে স্থবির হয়ে গেছে দেশ। এ কঠিন মুহূর্তে মারকাজুল ইসলামীর কাজ কী ধরনের?

মাওলানা জুবায়ের হুসাইন কাসেমী: সরকারি দিক-নির্দেশনায় মারকাজুল ইসলামী দেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনায় মৃতদের কাফন দাফনের ব্যবস্থা করছে। সরকার আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। কীভাবে লাশ গোসল ও কাফন দাফন করবো। আমরা সেভাবেই করোনায় মৃতদের কাফন দাফন করছি।

যেখানেই করোনায় মৃত্যু হয় সরকার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঠিকানা দেয়। আমরা সেখানে গিয়ে তাদের কাফন দাফনের ব্যবস্থা করছি। মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় আমরা এ পর্যন্ত ৩৫টি জানাজা কাফন দাফন সম্পন্ন করেছি। সারা দেশেই আমরা এ কাজ করার জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। সব ঠিক থাকলে আমাদের প্রস্তুতি নিতে দেরি হবে না ইনশাআল্লাহ।

আওয়ার ইসলাম: মারকাজুল ইসলামীর উল্লেখযোগ্য মানবসেবাগুলো যদি বলতেন।

মাওলানা জুবায়ের হুসাইন কাসেমী: আল-মারকাজুল ইসলামী এর উল্লেখযোগ্য কাজ তো অনেক। এরমধ্যে ১৯৮৮ সনে বন্যার সময় ত্রাণ বিতরণ দেশজুড়ে আলোচনায় এসেছে। ১৯৯২ সনে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রম। ১৯৯৮ সনে বন্যার সময় দেশব্যাপী বড় আকারে ত্রাণ বিতরণ।

রানা প্রাজা ট্রাজেডির সময় প্রাথমিক চিকিৎসাসহ হতাহতদের সব ধরনের সহায়তা। মারকাজের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স এর মাধ্যমে ফি রোগী ও লাশ বহন করা। বর্তমান রোহিঙ্গাদের শুরু থেকে কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত তাদের সবধরনের সাহায্য সহযোগিতা প্রদান।

বর্তমানে যেসব কার্যক্রম চালু আছে ১। ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। (গরিবদের জন্য)। ২। ফ্রি লাশ গোসল ও কাফন দাফন।

৩। মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানা নির্মাণ । ৪। মাদরাসা ও এতিমখানা পরিচালনা। ৫। বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল স্থাপন কার্যক্রম। ৬। আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানির জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন। ৭। ওজুখানা ও টয়লেট নির্মাণ।

৮। দুটি হাসপাতাল পরিচালনা। (একটি জেনারেল হাসপাতাল ও আর একটি চক্ষু হাসাপাতাল ) ৯। ফি চোখের ছানি অপারেশন। ১০। ফ্রি জন্মগত ঠোঁট ও তালু কাটা রোগীদের অপারেশন। ১১। কিন্ডারগারর্টেন পরিচালনা।

আওয়ার ইসলাম: করোনার এ পরিস্থিতিতে করোনায় মৃতদের লাশ কাফন দাফন এর ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে আপনারা কী মানবিক সহায়তার কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন?

মাওলানা জুবায়ের হুসাইন কাসেমী: প্রাথমিকভাবে আমরা মানবসহায়তায় না গেলেও আমাদের সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করে অর্থের যোগান দেয়ায় আমরা আমাদের শাখাগুলো থেকে মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছি। ঢাকা, দোহার কেরানীগঞ্জ, নরায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল  এসব এলাকায় আমাদের শাখাগুলো থেকে চাল ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আমরা বিতরণ করছি। আর সাথে সাথে আমাদের ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, করোনায় মৃতদের লাশ কাফন দাফন তো আছেই।

আওয়ার ইসলাম: এ মহান কাজ করতে গিয়ে কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে?

আমরা এ মানবিক সহায়তা করতে, কিংবা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের লাশ কবরস্ত করতে সরকার আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করছেন। আমরা কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন হইনি এখন পর্যন্ত।

আওয়ার ইসলাম: দাফন কাফন করতে পিপি ই মাস্ক গ্লাব্স ইত্যাদি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন?

মাওলানা জুবায়ের হুসাইন কাসেমী: প্রাথমিকভাবে তো আমরা নিজেরাই এগুলো সংগ্রহ করেছি। কিন্তু সরকার যখন আমাদের এ কাজে আহ্বান করলেন। তখন আমরা এসব জিনিস সরকার থেকেই পাচ্ছি। সরকার পিপিই মাস্ক ও গাব্সসহ প্রয়োজনীয় জিনিস আমাদের সরবরাহ করছেন। শেষ হয়ে গেলে সরকারকে জানালে তারাই সেগুলো ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। তবে কাফন দাফন করতে অনেকেরই আত্মীয় স্বজন আসেন না। তাই আমাদেরই তাদের কাফনের কাপড়গুলো ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। আমরা মারকাজুল ইসলামী থেকে তাদের কাফনের কাপড়ের ব্যবস্থা করছি।

আওয়ার ইসলাম: করোনায় আক্রান্তদের জানাজার বিষয়টা কিভাবে আঞ্জাম দিচ্ছেন?

মাওলানা জুবায়ের হুসাইন কাসেমী: করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের আমরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে কাফন দাফন ও জানাজার নামাজ আদায় করে থাকি। আমাদের কার্মীদের মধ্যে সাধারণত ৬ জন কিংবা সাতজন থাকে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আমরা জানাজার নামাজ আদায় করে তাদের কবরস্ত করি।

আওয়ার ইসলাম: আপনার চোখে দেখা অসহায় মানুষের চিত্র একটু যদি বলতেন। যেন মানুষ এ কাজে এগিয়ে আসে। তাদের প্রতি সহায়তায় মানুষ এগিয়ে আসবে।

মাওলানা জুবায়ের হুসাইন কাসেমী: অসহায় মানুষদের অবস্থা তো খুবই কঠিন। এখন তো সবচেয়ে বড় অসহায় হলো যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। তাদের থেকে অসহায় এখন তো কেউ নাই বলে মনে হচ্ছে। আজ দুনিয়ার কত সম্পদশালীরা মারা যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা তাদের আত্মীয়দের ফোন করে অনুরোধ করেও তাদের লাশের কাছে আনতে পারছি না। এমনকি করোনায় মৃতব্যাক্তিদের আত্মীয়রা আজ শিকার করতেই রাজি না যে এ মৃতব্যক্তি তাদের আত্মীয় হয়।

আজ তাদের মত অসহায় আমার মনে হয় আর কেউ নেই। অথচ মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত তার কাফন দাফন সম্পন্ন করা। তারজন্য দোয়া করা। মানুষ করোনায় মৃতদের কাছেই আসতে ভয় পাচ্ছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। মানুষ মারা যাওয়ার তিন থেকে চার ঘণ্টা পর তার শরীরে আর কোনো ভাইরাস থাকে না। তখন আর সংক্রমণ  হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

তারপরও আমরা পিপিই পরে গ্লাবস পরে আমরা তাদের গোসল কাফন দাফন করে থাকি। এ কঠিন অবস্থায় তাদের আত্মীয় স্বজন যদি আমাদের সঙ্গে থাকেন। তাদের কিছু করতে হবে না। শুধু যদি সঙ্গে থাকেন তারপরও আমরা সাহস পাই। আমাদের ভালো লাগে।

আর দ্বিতীয় বিষয় হলো, বিশ্বব্যাপী এ কঠিন অবস্থার মাঝে মধ্যবিত্ত অনেক পরিবার আছে খুব কষ্টে দিন যাপন করছে। বিশেষ করে আমরা যদি আলেমদের দিকে বেশি খেয়াল করি। তারা কারো কাছে চাইতে পারে না। রাতের আঁধারে আমরা যদি তাদের ঘরে সহায়তা পাঠাই এটাই হবে সবচেয়ে বড় সাওয়াবের কাজ। এ মুহূর্তে অনেকের ঘরে চুলাটাও জ্বলছে না। তাই যারা যেমন সামর্থ আছে এগিয়ে আসা উচিত।

আমরা ইতিপূর্বে দেশের কঠিন কঠিন দুর্যোগে এত ফোন পাই নাই। এ কঠিন পরিস্থিতিতে যতটা ফোন পাচ্ছি। আগেকার দুর্যোগগুলোতে অল্পসংখ্যক মানুষ অসহায় হতো। এখন তো এমন অবস্থা, যারা দাতাও তারাও এখন অসহায়। মানবিক দাবি হিসেবে এখন সবারই এগিয়ে আসা উচিত। সবাই এগিয়ে এলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তায়ালা আমাদের জীবন চালনা সহজ করে দিবেন। এ কঠিন মুহূর্তে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তাওবা ইস্তেগফার করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

-এটি


সম্পর্কিত খবর