মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৭ শাওয়াল ১৪৪৫


মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উপেক্ষিত ইসলাম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ ইমরান।।

মুক্তিযুদ্ধ। পাক-হানাদারের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম। ১৯৭১ বাংলার মুক্তি ও স্বাধীনতার বছর। সময়টা ছিল পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রাম ও আন্দোলনের। দীর্ঘ নয় মাস শেষে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্তি পায়। বাঙালি জাতির বুকের আওয়াজ, 'পরাধীনতার শৃংখল থেকে যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যু বরণ করা অনেক উত্তম'।

১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে ‘ইসলাম’ ব্যবহৃত হয়েছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে। পাকিস্তানের হানাদাররা ইসলামের নাম দিয়ে জায়েজ করেছে গণহত্যাকে। সেকুল্যাররা পাকিস্তানিদের ‘ইসলাম’ ব্যবহারকে কূটনীতিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। তারা মুক্তিযুদ্ধে ইসলামকে উপেক্ষিত করতে চেয়েছে। এ চেষ্টা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় সফল হতে দেয়নি এদেশের আপামর জনতা।

কারণ জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও বেতার কেন্দ্র মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ইসলাম ও ধর্মীয় চেতনার মাধ্যমে। এদেশের মানুষ ধর্মের প্রতি প্রাচীন যুগ থেকে সহনশীল। তাই ধর্মকে উপেক্ষা করে কোনো আন্দোলন সম্ভব নয় এদেশের মাটিতে। ৪৭ এর দেশভাগ, খেলাফতে আন্দোলন ও হিন্দু-মুসলিমের দাঙ্গা থেকে জাতীয় নেতৃবৃন্দ এ উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার পর এদেশের সেকুল্যারপন্থী বুদ্ধিজীবীরা দ্বিতীয়বার ইসলামকে উপেক্ষিত করার চেষ্টা শুরু করেন। দেশ স্বাধীনের পর বিভিন্ন কৌশলে সরাসরি ইসলামকে উপেক্ষিত না করে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও হুজুরদের উপর কূটনৈতিক আক্রমণ করে নানারঙে। রাজাকার মানে দাড়ি টুপি গোছের লম্বা কোর্তা পরা হুজুর পরিচয়ের নির্মম মানুষগুলো।

সেক্যুলারপন্থীরা বহুত আগে ধরতে পেরেছে, ধর্মের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে যখন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে শনাক্ত করা যাবে, তখন ধর্ম বা ইসলাম এমনিতেই উপেক্ষিত হবে জনমনে।

এজন্য নানান কৌশল অবলম্বন করে তারা। সাহিত্য এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জাতিভেদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানদের স্বাধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রয়াস হরহামেশাই। জাতি ও বাঙ্গালী পরিচয়ের নতুন নতুন প্রশ্ন উদ্ভাবন করে। কখনো বাঙালির ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে, কখনো মুসলিম পরিচয় নিয়ে, এদেশের মুসলমান বাঙালি পরিচয়ে চলবে নাকি শুধু মুসলমান পরিচয়ে এজাতীয় প্রশ্নের ছাড়াছাড়ি সর্বত্র এখন। এ ধরণের প্রশ্নের অন্দরে তাদের উদ্দেশ্য হলো, স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে ধর্মকে মুছে দেয়ার কূটকৌশল। এদেশকে হিন্দুত্ব কালচারে সংজ্ঞাজাত করার হীনপ্রচেষ্টা।

আধুনিক কেন্দ্রিভূত রাষ্ট্রদর্শন পৃথিবীতে শুধু ভূখন্ডকেন্দ্রিক দেশীয় পরিচয়ের বিভাজন তৈরি করেনি। বরং পৃথিবীর প্রতিটি সত্ত্বাকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে নানা পরিচয়ে। এছাড়াও জনজীবনকে করেছে অনেক দূসাধ্যময়। ইচ্ছে করলে নিজ দেশের বাইরে আমি যেতে পারি না। আমার দেশে আমি ফুটপাতে থাকি আর এয়ারকোন্ডিশনে। আমি সমান নাগরিকত্বের অধিকারি। কিন্তু স্বদেশের বাইরে পরবাসী আমি। যেখানে আমাকে চলতে হয় সুনির্দিষ্ঠ চুক্তি ও সীমানাভূক্ত নিয়মে।

বস্তুত আধুনিক কেন্দ্রিভূত রাষ্ট্রে স্বাধীনতা এবং নাগরিকত্ব দু'টোই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান বিশ্বে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং নাগরিকত্বের অধিকার অনস্বীকার্য বিষয় এখন। যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশীয় রাজীনীতি বা দেশীয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকতে চায় তারা বস্তুত ধর্মকে একটা হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন দিনকেদিন। হোক সেটা গণতন্ত্র বা অন্য কোন মতবাদ প্রতিষ্ঠিতি রাষ্ট্র।

ধর্ম মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শন কোন জাতির মৌলিক পরিচয় ছিল একসময়ে। কিন্তু আধুনিক কেন্দ্রিভূত রাষ্ট্র ও ধর্মেনিরেক্ষার প্রভাবে ক্রমেই ধর্মকে যেমন ব্যক্তিসত্ত্বার মাঝে সীমাবদ্ধ করেছে, তেমনি ধর্মের নামে জাতি পরিচয়কেও মুছে ফেলার প্রয়াস ক্রমবর্ধমান রয়েছে বর্তমান বিশ্বে।

কিন্তু ধর্মীয় "জাতি" পরিচিতির সাথে ভৌগলিক জাতি পরিচয় কখনো সাংঘর্ষিক ছিল না ইসলামের সঙ্গে। সুলাতানী আমলে ও সাম্রাজ্যভুক্ত রাষ্ট্রযুগে প্রদেশভিত্তিক মুসলিম সুলতান ও সম্রাটগণ নানান বরাদ্দ ও বাজেটগঠন করতেন। ভূখন্ড ও ভাষাভিত্তিক জাতিগোষ্ঠীর কাছে গভর্ণর পাঠান। আলাদা কাজী পাঠাতেন যেকোন বিষয়ে সমাধানের জন্য। এছাড়া বর্তমান বিশ্বে প্রাদেশিক রাষ্ট্রগুলোতে আমরা এর বাস্তবতা দেখতে পাই। যেখানে কোথাও ধর্মের পরিচয় কোথাও ভৌগলিক জাতি পরিচয় চলছে।

ভৌগোলিক পরিচয়ে যারা ধর্মের পরিচয়কে দেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করে তারা মূলত ধর্মের প্রতি বিদ্বেষভাবটাই উগলিয়ে ফেলেন। এ উগলানো মনোভাব তৈরি হওয়ার পিছনে নৈতিক দোষটা কিন্তু ট্যাডিসনালিষ্টদের ঘাঁড়ে চাপে। কারণ তাদের মনোভাব কখনো স্বাধীনতার ইতিহাস এবং স্বদেশ প্রেমের প্রতি আবদ্ধ হতে দেখা যায় না। তাদের শৈথিল্য মনোভাব বিদ্বেষানল বুদ্ধিজীবিদের দাবীকে শক্তিশালী করছে প্রতিনিয়ত।

এজন্য দেশীয় ট্যাডিসনালিষ্ট মৌলিবীদের স্বদেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধকে স্বাধীনতাবোধ থেকে গ্রহণ করা জরুরী একটি বিষয়। তা না হলে সেক্যুলাদের উগলানো বমি গ্রহণ করবে সংস্কৃতি বা মুক্তিচিন্তার নামে নতুন কোন চিন্তা বা সংস্কৃতি হিসেবে বাংলার লালায়িত বাঙ্গালী। যেখানে ধর্ম বির্বজিত নিষ্কলুষ নাস্তিক্যবাদ জন্মভূমির তৈরি হবে। তাছাড়া ট্যাডিসনালরা যদি মুক্তিযুদ্ধের সাথে ইসলাম পরিচয়ের আপত্তি জায়গা থেকে সরে না আসে, তাহলে সেক্যুলার নিমকহারামিদের কূটনামি প্রবাহমান বিদ্বেষানল তরক্কি হবে ধারাবাহিক হারে।

কিন্তু স্বাধীনতা কারো একচ্ছত্র আধিপত্যের করতলে জন্ম নেয়নি। এটা এজাতির মুষ্টিবদ্ধ অধিকার। অর্থ্যাৎ স্বাধীনতা উত্তরাধিকার কখনো একতরফা নয় এটা গোটা বাঙালী জাতির, হোক সে হিন্দু বা মুসলিম বা অন্য যে কোন ধর্মের। তবে ঐতিহাসিক ভাবে বাঙালি প্রজন্মকে জানাতে হবে মুক্তিযুদ্ধে ইসলাম ও মুসলামানের অবদান কী। মুসলিম পরিচয় কখনো বাঙ্গালী পরিচয়ের প্রতিপক্ষ ছিল না।

এদেশে হাজারো বছর বাঙ্গালী পরিচয়ে ইসলামই চর্চিত হয়নি শুধু বরং পূর্ণ দ্বীন বাস্তাবায়িত হয়েছিল একসময়। তখনও আমরা বাঙ্গালী ছিলাম, আজও আমরা বাঙ্গালী। তবে আমাদের মুসলিম পরিচয় কখনো বিচ্ছিন্ন হয়নি আমাদের বাঙ্গালী জাতিসত্তা থেকে।

লেখক: তরুণ আলেম, কলামিস্ট

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ