মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫


যে রত্ন হারিয়ে ব্যাকুল সবাই

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জহির উদ্দিন বাবর ।।

পৈত্রিক সূত্রে হজরত মাওলানা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ. সিলেটের মানুষ। তবে তাঁর জন্ম কিশোরগঞ্জে। শহীদি মসজিদের দোতলায় ছিল আতহার আলী রহ.-এর বাসা, সেখানেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এজন্য জীবনের পুরোটাই আবর্তিত হয়েছে কিশোরগঞ্জকে কেন্দ্র করে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি ছিল, কিন্তু তিনি কিশোরগঞ্জের মাটি ও মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে গিয়েছিলেন। মায়াবি এই শহরেই কেটেছে তাঁর পুরো জীবন। বাবার হাতে গড়া জামিয়া ইমদাদিয়া আর শহীদি মসজিদই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান।

আশির দশকের শুরু থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন জামিয়া ইমদাদিয়ার মুহতামিম আর শহীদি মসজিদের খতিব ও মুতাওয়াল্লি। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ইট-পাথরের সঙ্গে মিশে আছে শাহ সাহেব রহ.-এর শ্রম ও সাধনা।

কিশোরগঞ্জসহ গোটা ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের অভিভাবক ছিলেন শাহ সাহেব রহ.। এই অঞ্চলের দীনি বিষয়াদি তাঁর নেতৃত্বেই আবর্তিত হতো। যেকোনো দীনি প্রতিষ্ঠানে সংকটের সৃষ্টি হলে সবাই শরণাপন্ন হতেন শাহ সাহেব রহ.-এর।

আর কিশোরগঞ্জ জেলাজুড়ে ধর্মীয় অঙ্গনে শাহ সাহেবের চাওয়ার বাইরে কিছু হওয়ার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। কোনো ব্যাপারে শাহ সাহেব বলেছেন সেটার বিপরীত করার মতো হিম্মত এই জেলায় কারও ছিল না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর শাহ সাহেবের একচেটিয়া প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। সবাই তাঁকে অভিভাবক হিসেবে অসম্ভব মানত, তাঁকে শ্রদ্ধার অনন্য মণিকোঠায় স্থান দিতো।

সাধারণত আলেম-উলামার প্রভাব মসজিদ-মাদরাসাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন শাহ সাহেব রহ.। কিশোরগঞ্জের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনেও শাহ সাহেব রহ.-এর প্রভাব ছিল অবিশ্বাস্য রকমের।

স্থানীয় প্রশাসন তাঁকে অসম্ভব সমীহ করতো। জামিয়া ইমদাদিয়ার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক মজলিসে আমেলার সভাপতি হন। এজন্য যখন যে জেলা প্রশাসক কিশোরগঞ্জে এসেছেন তিনিই শাহ সাহেবের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছেন। শাহ সাহেবের ভক্ত নন এমন কোনো ডিসি আজ পর্যন্ত কিশোরগঞ্জে আসেননি।

যেহেতু তিনি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না এজন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছে তিনি ছিলেন অনেক প্রিয়। সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা ও সমীহ করতো। এমনকি যারা ধর্মকর্মের ধার ধারেন না তাদের কাছেও প্রিয় ছিলেন শাহ সাহেব হুজুর।

এককথায় কিশোরগঞ্জের সাধারণ-অসাধারণ প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে তাঁর অবস্থান ছিল অনন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার। সর্বমহলের এতোটা ভালোবাসার মানুষ নিকট অতীতে কিশোরগঞ্জে আসেননি এবং ভবিষ্যতে আসবে কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তিনি সবার কতটা ভালোবাসার ছিলেন সেটা তাঁর জানাজায় লাখ লাখ লোকের উপস্থিতি দেখেই টের পাওয়া গেছে।

দুই.

কিছু গুণের কারণে শাহ সাহেব ছিলেন মানুষের অত্যন্ত প্রিয়। বিশেষ করে তাঁর তেলাওয়াত ছিল খুবই মধুর। তাঁর তেলাওয়াত শুনে কেউ মুগ্ধ না হয়ে থাকতে পারতেন না। তিনি যখন তেলাওয়াত করতেন তখন মনে হতো প্রতিটি শব্দ যেন আসমান থেকে এইমাত্র অবতীর্ণ হচ্ছে! মাহফিলগুলোতে তাঁর বয়ানের চেয়েও তেলাওয়াত বেশি শুনতে চাইতেন শ্রোতারা।

দীর্ঘদিন শহীদি মসজিদে রমজানে একা বিশ রাকাত তারাবি পড়িয়েছেন। তাঁর মাধুর্যপূর্ণ তেলাওয়াতের কারণে তারাবির কোনো কষ্টই অনুভূত হতো না। একটা সময় মাঝে মাঝে ফজরের নামাজেও তিনি ইমামতি করতেন। সেই তেলাওয়াতটি ছিল আরও বেশি আকর্ষণীয় ও মুগ্ধতায় ভরা। যারা একবার শাহ সাহেব হুজুরের তেলাওয়াতের স্বাদ পেয়েছেন তারা বারবার শহীদি মসজিদে ছুটে আসতেন তাঁর পেছনে নামাজ পড়ার জন্য।

জীবনে দেশে-বিদেশে অনেক মসজিদে জুমা পড়েছি। কিন্তু শাহ সাহেবের মতো এতো প্রাণবন্ত কোনো খতিবের দেখা আজ পর্যন্ত পাইনি। তাঁর অন্যান্য আলোচনার চেয়ে জুমার নামাজের পূর্বের আলোচনা অনেক বেশি গোছালো, তথ্যনির্ভর ও উপকারী হতো।

একদম তাজা ইস্যু নিয়ে কুরআন-হাদিসের আলোকে অসাধারণ বয়ান করতেন। ইলমি ভাণ্ডারের কোনো কমতি ছিল না। আর বলার ভঙ্গিও ছিলও অসাধারণ। বিশুদ্ধভাষী এমন খতিব খুব কমই চোখে পড়ে। আর খুতবায় ছিল তাঁর একটা বিশেষ স্টাইল। আরবি স্টাইলে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করতেন। ধ্বনির উঠা-নামা অন্যরকম এক ব্যঞ্জনা এনে দিতো সেই খুতবায়। দ্বিতীয় খুতবায় ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জন্য যে দোয়াগুলো করতেন সেটা সাধারণত কোনো খতিবের খুতবায় পাওয়া যায় না। সবমিলিয়েই তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী খতিব।

শাহ সাহেবের পেছনে জুমা পড়তে সকাল ১০টা থেকেই লোকজন আসতে থাকত শহীদি মসজিদে। জুমার আজানের আগেই মসজিদ ভরে যেতো কানায় কানায়। গায়ে জড়ানো হলুদ আবা আর সাদা পাগড়ি পরা কাক্সিক্ষত খতিব যখন মেহরাবের ভেতরের ছোট্ট দরজাটি খুলে ঢুকতেন তখন শহীদি মসজিদের মুসল্লিদের মধ্যে অন্যরকম এক চাঞ্চল্য বিরাজ করতো। মনে হতো তারা সাত আসমানের তারার সন্ধান পেয়ে গেছে!

চারদিকে বিরাজ করতো পিনপতন নীরবতা। হুজুর সাধারণত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বয়ান করতেন। প্রায় আধাঘণ্টার বয়ানে তিনি তুলে ধরতেন ইসলাম, দেশ, জাতি ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের নানা প্রসঙ্গ।

মুসল্লিদের ব্যাপক চাওয়ার কারণে দেশের যেকোনো প্রান্তে প্রোগ্রাম থাকুক, তিনি জুমা পড়ানোর জন্য ছুটে আসতেন। সিলেটের হজরত শাহজালাল দরগা মসজিদে মাসে এক জুমা পড়াতেন। যেদিন শহীদি মসজিদে তিনি জুমা পড়াতেন না সেদিন চার দিকে যেন একটা শূন্যতা বিরাজ করতো। প্রিয় সেই খতিবকে কিশোরগঞ্জবাসী এখন প্রতি জুমাতেই খুঁজে বেড়াবে। অনুভব করবে তাঁর গভীর শূন্যতা। যে শূন্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়।

‘একজন আলেমের মৃত্যু আলমের মৃত্যু’ হাদিসের এই বাক্যটি কতটা যথার্থ সেটা আঁচ করা যায় শাহ সাহেব হুজুরের চলে যাওয়ার ক্ষত থেকে। যত শোকগাথাই রচিত হোক, যত অশ্রুই বিসর্জন দেয়া হোক, আক্ষেপ আর আকুতি যতই প্রকাশ করা হোক; তাঁর শূন্যতার গভীরতা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়।

যে অনন্য উচ্চতায় ছিল তাঁর অবস্থান, বহুমাত্রিক যোগ্যতার যে স্ফূরণ তিনি ঘটিয়ে গেছেন বর্ণাঢ্য জীবনে; যে কীর্তিগাথা তিনি রচনা করে গেছেন পদে পদে সেখান পর্যন্ত পৌঁছার মতো কাউকে আপাত দৃষ্টিতে চোখে পড়ছে না। তবুও আল্লাহ সবকিছুর ওপর শক্তিমান; তিনি চাইলে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। আমরা শুধু দোয়া করি, আল্লাহ শাহ সাহেব হুজুরের শূন্যতা পূরণ করে দিন। আর তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমিন।

লেখক: হজরত আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ.-এর গুণমুগ্ধ ছাত্র

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ