শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


বিশ্ব ইজতেমা: কলেজ ভার্সিটির ছাত্রদের উদ্দেশ্যে খাস বয়ান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দিন (শুক্রবার) বেলা ১০ টা থেকে শুরু হয় স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের  উদ্দেশ্যে বিশেষ বয়ান। আওয়ার ইসলামের পাঠকদের জন্য বয়ানটি শ্রুতিলিখন করেছেন মাসিক ঈশান  সম্পাদক মুহাম্মদ বিন ওয়াহিদ


আমাদের জীবন হল বরফের মত। বরফ যেমন গলে গলে একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়, তেমনি ভাবে জীবনও একসময় শেষ হয়ে যাবে। বরফ গলানোর দুইটা প্রক্রিয়া হতে পারে। প্রথম, আমরা বরফের খণ্ডকে বড় একটি পাত্রে রাখব। আসতে আসতে সেটা গলতে থাকবে। সেই গলিত বরফের পানি তৃষ্ণার্ত মানুষ পান করে পরিতৃপ্ত হবে। আর আমার জন্য দোয়া করতে থাকবে।

আরেকটা প্রক্রিয়া হতে পারে, বরফ খণ্ডকে রাস্তার উপরে অযত্নে ফেলে রাখবো, আর সেটা গলতে থাকবে। বরফ গলিত পানিতে রাস্তা কাদা হবে। যাতায়াত করতে লোকদের কষ্ট হবে। পথচারী যখন ওই পথ দিয়ে চলবে, তখন আমাকে গালমন্দ এবং বদ দোয়া করতে করতে যাবে।

তেমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে একটি জীবন দান করেছেন। সেই জীবনকে আমরা নেক আমল করতে করতেও শেষ করতে পারি, আবার আল্লাহ এবং তার রাসূলের নাফরমানি করতে করতেও শেষ করে দিতে পারি। বুদ্ধিমানের কাজ হল, নেক আমল করতে করতে, আল্লাহ এবং তার রাসূলকে খুশি করতে করতে জীবন যাপন করা এবং আখেরাতের সফলতার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

দুনিয়ার জীবনেও সফলতা আসে একমাত্র দীন মানার মাধ্যমে। অন্যকোন মাধ্যমে সফলতা আসে না। পৃথিবীতে মানুষ আগমনের পদ্ধতি হল, মায়ের গর্ভ। মানুষ তার মায়ের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করে। তেমনিভাবে আমার আপনার জীবনে সফলতা আসার জন্যও একমাত্র পথ ও পদ্ধতি হল দীন।

পানি ছাড়া যেমন কোনো প্রাণীর জীবন চলে না। তেমনি ভাবে দীন ছাড়াও মানুষের জীবন চলতে পারে না। দীন মানার দ্বারা যে জীবন পরিচালিত হবে তাকে বলে পবিত্র জীবন। কুরআনের ভাষায় যাকে বলে হায়াতে তাইয়েবা। আখেরাতের সফলতাই হলো প্রকৃত সফলতা। যেমন কুরআনে আছে, ‘তাদের জন্য রয়েছে মহা সফলতা’।

যেমন আমরা গরু কিনি দুধ খাওয়ার জন্য। দুধ ছাড়া গরু থেকে অন্যকোন কিছু পাওয়া আমাদের উদ্দেশ্য থাকে না। তবুও গরুর সাথে আমরা গোবর পেয়ে যাই। কিন্তু কেউ কোন দিন গোবর কেনার নিয়ত করে না। তেমনি ভাবে আমি আর আপনি যখন দীন মানবো, দীনের ওপরে নিজেকে পরিচালিত করব, দুনিয়ার সমস্ত কাজের ক্ষেত্রেও দীনকে প্রাধান্য দিব, তখন দুনিয়ার বিভিন্ন আসবাবও আমাদের এমনিতেই অর্জিত হয়ে যাবে। দোস্তবুজুর্গ, দীন মানার দ্বারা নগদ কিছু সফলতা এবং উপকার পাওয়া যায়।

দীন মানলে প্রথমত হায়াতে তাইয়েবা লাভ হয়। আর যখন আমার আর আপনার জীবন এবং হায়াতটা হায়াতে তাইয়েবা হয়ে যাবে, তখন আমি জীবনের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে প্রশান্তির নেয়ামত লাভ করব। আমার জীবনে শান্তি আর শান্তি চলে আসবে।

দীন মানার দ্বিতীয় পুরস্কার হল, যে দীন মানবে মানুষের অন্তরে তার জন্য মোহাব্বত ঢেলে দেয়া হয়। তখন সবাই তাকে মোহাব্বত করতে থাকে। সমস্ত মানুষ যখন তাকে মোহাব্বত করতে থাকে তখন ফেরেস্তারাও তাকে মোহাব্বত করতে থাকে। আর আসমানে ঘোষণা করতে থাকে, ‘অমুক ব্যক্তিকে আমরা মোহাব্বত করি, সুতরাং তোমরাও থাকে মোহাব্বত কর’।

তৃতীয় পুরস্কার হল, আল্লাহ তায়ালা তাকে বরকতের জীবন দান করেন। জীবনের পদে পদে সে বরকত অনুভব করতে থাকে। হুজুর সা. এর জামানায় দেখা গেছে, দুইজনের দুধ সত্তর জনপান করে নিয়েছেন । তবুও পেয়ালায় দুধ যেমন ছিল তেমনই রয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা সেই দুধে বরকত দিয়ে ছিলেন।

দীন মানার চতুর্থ পুরস্কার হল, সমাজে ইজ্জত-সম্মান বৃদ্ধি পায়। সবাই তাকে সম্মান করে। কাউকে সম্মান প্রদর্শন দুইভাবে হতে পারে। এক তো হল, লোক দেখানো সম্মান। যেমন চেয়ার বা পদের মাধ্যমে যে সম্মান পাওয়া যায়, সেটা দিল থেকে হয় না। ভয়ের কারণে বা নিজের সার্থসিদ্ধি করার জন্য তাকে সম্মান করে।

আর যে ব্যক্তি দীন মানে তাকে লোকেরা তাকে খুশি করার জন্য নয়, তার প্রতিপত্তির ভয়েও নয়, বরং দিল থেকে তাকে মোহাব্বত করে। এমনকি সে যখন মারা যায়, তখন কেউ তার শুধু নাম মুখে আনে না। বরং সম্মানসূচক কোনো শব্দ ব্যবহার করে। যেমন, অমুক সাহেব মারা গেছেন। অমুক হযরত মারা গেছেন।

আমরা হুজুর সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লামের নাম নিলে "সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম" বলি। সাহাবিদের নাম নিলে ‘রাযিয়াল্লাহু আনহুম’ বলি। মৃতবুজুর্গদের নাম নিলে ‘রহমাতুল্লাহি আলাইহি’ বলি। জীবিত বুজুর্গদের নাম নিলে ‘দামাত বারাকাতুহুম’।

পক্ষান্তরে পদ বা চেয়ারের ভয়ে, নিজের কর্তৃত্বের কারণে যাকে সম্মান করা হয়, সে যখন মারা যায়, তখন সে যা রেখে যায় সবকিছু তার দাফন কার্যের আগেই তা ভাগবাটোয়ারা হয়ে যায়। এমনকি তার পকেটে একটা পয়সা থাকলে সেটাও ভাগাভাগি হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, লোকেরা তার নামটাও ঠিকমত মুখে আনে না। এই হল দুই ধরনের সম্মানের মধ্যে পার্থক্য।

মৃত্যুর পরে দুনিয়ার কোনো বস্তুই কাজে আসবে না। কাজে আসবে শুধু দীন। কবরের মধ্যে তিন প্রশ্নের এক প্রশ্ন হবে, তোমার দ্বীন কী ছিল? নেককার বান্দার রুহ যখন বের করা হয়, তখন ফেরেস্তারা তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য আসে। আল্লাহ তায়ালা ফেরেস্তাদের কে বলেন, তাকে ইল্লিয়িনে পৌঁছে দাও। তখন ফেরেস্তারা তাকে ইল্লিয়্যিন নামক জান্নাতে পৌঁছে দিবেন।

২.
ফেরেস্তারা যখন নেককার বান্দার জান কবজ করেন, তখন দুনিয়ার আমলগুলো বান্দাকে বেষ্টন করে রাখে৷ নামাজ থাকে তার ডান পাশে। রোজা থাকে বাম পাশে। কুরআন মাথার ওপরে। এবং দীন মানতে গিয়ে বান্দা যেই কষ্ট-মুশাক্কাতগুলো সহ্য করেছে, সেই কষ্টগুলো তার পায়ের কাছে অবস্থান করতে থাকে। বান্দার আমলে যখন ঘাটতি দেখা দেয়, তখন ওই কষ্ট সহ্য করার প্রতিদানগুলো তার আমলের ঘাটতিগুলো পূরণ করে দেয়।

মৃত্যুর সময় মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করতে থাকে। জায়গাটা কেমন হবে, কবরে আলো থাকবে না অন্ধকার! ফেরেস্তারা নেককার বান্দাকে জান্নাতের প্রতি উৎসাহিত করতে থাকে। বলতে থাকে, তোমার নেয়ামত কখনো শেষ হবে না। তুমি চিরন্তন নেয়ামত লাভ করবে। হাউজে কাওসার লাভ করবে।

দোস্তো বুজুর্গ, এই হাউজে কাওসারের পানির মধ্যে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য থাকবে। দুধের চেয়ে সাদা হবে, মধুর চেয়ে মিষ্টি হবে,মেশকের চেয়ে সুঘ্রাণ হবে, বরফের চেয়ে ঠাণ্ডা হবে। এই স্বাদের পানি হুজুর সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে বান্দাকে পান করাবেন।

আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে এমন জান্নাত দান করবেন, যার মধ্যে কোনো চিন্তাভাবনা থাকবে না। ভয় থাকবে না। কোনো অভাব অনটন থাকবে না। সমস্যা থাকবে না। সর্বপ্রথম নেয়ামত হবে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সালাম। আর সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ের নেয়ামত হবে আল্লাহ তায়ালার দিদার।

ভাই, এই সমস্ত জিনিস পাওয়ার জন্য আমাদের দ্বীনের পেছনে মেহনত করতে হবে। যেমন দুনিয়ায় কিছু পাওয়ার জন্য প্রথমে মেহনত করি তারপর ফলাফল ভোগ করি।

ভাই, যখন কোনো গাছের মধ্যে ফল আসে তখন সেটা ঝুকতে থাকে। তেমনিভাবে যখন কোনো মানুষের মধ্যে দীন আসে তখন তার মধ্যে নম্রতা আসে। কোনো মানুষ যখন গাছের দিকে পাথর মারে তখন গাছ পাল্টা পাথর মারে না। বরং পাথরকে নিচের দিকে ফেলে দেয়, আর তাকে ফেরত দেয় ফল।

ভাই আমরা দীন মানবো, দীনের মেহনত করবো, তার মানে এই নয় যে আমরা আমাদের ডিগ্রিকে ফেলে দিব, পড়াশোনা আর করবো না। বরং এখন থেকেই নিয়ত করবো যে ডিগ্রির মাধ্যমে দীন কায়েম করব। তখন আমার ডিগ্রি শুধু ডিগ্রি থাকবে না। দীন বনে যাবে।

সাহাবায়ে কেরাম যুদ্ধের জন্য ঘোড়া লালন পালন করতেন। পরস্পরে এ ব্যাপারে তারা আলোচনাও করতেন। আল্লাহর কাছে ব্যাপারটা পছন্দ হওয়ার কারণে তা কুরআনেও তাদের সেই কথাবার্তা এসেছে ।

আরএম/

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ