শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


হারিয়ে যাওয়া পাঁচটি মাসিক পত্রিকা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুনীরুল ইসলাম ।।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত হচ্ছে অসংখ্য ইসলামি পত্রপত্রিকা। প্রচার করছে সত্য ও সুন্দরের বাণী। এটা আমাদের জন্য আশাজাগানিয়া গল্প। কিন্তু এরচেয়ে বেশিসংখ্যক পত্রিকা আমাদের থেকে হারিয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। রাজধানী থেকে প্রকাশিত হারিয়ে যাওয়া এমন পাঁচটি মাসিক পত্রিকার গল্পই এবার শোনাচ্ছি।

কাবার পথে

স্লোগানটা ছিল ‘যাবার পথে, সঙ্গে রাখুন কাবার পথে’। ১/ক পুরানা পল্টন থেকে বের হতো এই ‘কাবার পথে’। ১৯৯৩ সালের দিকে পত্রিকাটির পথচলা শুরু। সম্পাদক ছিলেন মুফতি সাইফুদ্দীন ইয়াহইয়া। পর্যায়ক্রমে সম্পাদনা বিভাগে কাজ করেছেন এবিএম শিহাবউদ্দিন শিহাব, ড. মুফতি মুহাম্মদ গোলাম রববানী, গাজী আতাউর রহমান, শাহ ইফতেখার তারিক, রায়হান মুহাম্মদ ইবরাহীম, জহির উদ্দিন বাবর, হাফেজ আহমদুল্লাহ, হুমায়ুন আইয়ুব প্রমুখ। ইসহাক ওবায়দী, মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, শরীফ মুহাম্মদ, মহিউদ্দিন আকবর, আবদুল খালেক জোয়ারদার, লাবীব আব্দুল্লাহ এতে নির্ধারিত বিষয়ে লিখতেন। এছাড়া নবীন তরুণ লেখকরা সমসাময়িক বিষয়ে লিখতেন।

পরিপাটি ও পরিকল্পিতভাবে প্রকাশ হতো পত্রিকাটি। এটি বেশ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সম্পাদক মুফতি সাইফুদ্দীন ইয়াহইয়া ছিলেন তখনকার ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা। এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করিম পীর সাহেব চরমোনাই রহ.। তাই এই অঙ্গনেও পত্রিকাটির বাড়তি পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। একসময় পত্রিকাটির সম্পাদক হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। সম্ভবত ২০০৯ সালের জুন-জুলাইয়ের দিকে সর্বশেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল।

যমযম

‘সময়ের ভাষায় সত্যের পথ’ স্লোগানকে ধারণ করে ৫৫/১ পুরানা পল্টন থেকে বের হতো ‘মাসিক যমযম’। ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে পত্রিকাটির পথচলা শুরু হয়। সরকারি নিবন্ধন অনুযায়ী পত্রিকাটির সম্পাদক বিশিষ্ট লেখক শরীফ মুহাম্মদ আর প্রকাশক বিশিষ্ট ক্যালিগ্রাফি শিল্পী বশির মেসবাহ। যদিও পরবর্তী সময়ে সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন বিশিষ্ট লেখক ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী। পত্রিকাটির শুরুর দিকে নিয়মিত লিখতেন অধ্যাপক আবদুল গফুর, উবায়দুর রহমান খান নদভী, মাওলানা লিয়াকত আলী, মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, সরদার ফরিদ আহমদ। আর প্রতিবেদক ছিলেন জহির উদ্দিন বাবর ও গাজী মুহাম্মদ সানাউল্লাহ।

মূলত পত্রিকাটির স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। তিনি যমযমের আনুষ্ঠানিক যাত্রারও অনেক আগে এই নামে দুয়েকটি সংখ্যা করেছিলেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং ছোট পরিসরে করেছিলেন তখন। ২০০৬ সালে আনুষ্ঠানিক যাত্রা। পত্রিকাটিতে রুচি-বৈচিত্র্যের বেশ ছাপ ছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমসাময়িক ইস্যু এবং সমাজভাবনাসহ সুপরিকল্পিত বিষয়বিন্যাস, চমৎকার মেকাপ-গেটাপ পত্রিকাটিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল। উলামা-তোলাবার অঙ্গন ছাড়িয়ে এটি জেনারেল পাঠকমহলেও সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু এটির প্রকাশনাও একসময় বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটি মূলত কয়েকজন শেয়ারের আর্থিক যোগানের মাধ্যমে প্রকাশিত হতো। এতে ধারাবাহিক গচ্ছা যাওয়ায় একসময় বন্ধ হয়ে যায়।

আল আমানাহ

‘সহজ পথের পাথেয়’ স্লোগানকে ধারণ করে চুড়িহাট্টা চকবাজার থেকে বের হতো মাসিক ‘আল আমানাহ’। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকাটির পথচলা শুরু হয়। সম্পাদক ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ আবদুস সামাদ, নির্বাহী সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুল মুমিন। এছাড়া কয়েকজন তরুণ লেখক পত্রিকাটির সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শরীফ মুহাম্মদ, ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী, আইয়ুব বিন মঈন, মুফতি এনায়েতুল্লাহ, জহির উদ্দিন বাবর, মুসা আল হাফিজসহ নবীন-তরুণ লেখকরা এতে লিখতেন।

এটিও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং ইসলামি পত্রিকাজগতে পরিচিতি পেয়েছিল। পত্রিকাটির ব্যানারে লেখক তৈরি ও কালচারাল অনেক প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করে এবং ২০১০ সালে মনোনীত লেখকদের ‘আল আমানাহ অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। এছাড়া ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে পত্রিকাটি বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করে। এর মধ্যে ‘কবিতা সংখ্যা’ ও ‘গল্প সংখ্যা’ বেশ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। ২০১৪ সালের জুন সংখ্যাটি ছিল হেফাজত সংখ্যা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এটিই ছিল পত্রিকাটির সর্বশেষ সংখ্যা। এরপরই সরকারি চাপে কর্তৃপক্ষ এটির প্রকাশনা বন্ধ রাখতে বাধ্য হন বলে জানা যায়।

মুক্ত আওয়াজ

‘মুক্তমনে সামনে চলার অঙ্গীকার’ স্লোগানকে ধারণ করে ৫৫/বি পুরানা পল্টন থেকে বের হতো মাসিক ‘আমাদের মুক্ত আওয়াজ’। ২০০৬ সালের শেষের দিকে পত্রিকাটির পথচলা শুরু হয়। সম্পাদক ছিলেন আবু সাঈদ নোমান, নির্বাহী সম্পাদক আজিজুর রহমান হেলাল। বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শাহ আবদুল হালিম হোসাইনী, কামালুদ্দীন ফারুকী, হাসনাইন হাফিজ, রোকন রাইয়ান, মীর হেলাল, আবদুল গাফফার প্রমুখ। লিয়াকত আলী, জুবাইর আহমদ আশরাফ, উমায়ের কোব্বাদীসহ ইসলামি ঘরানার নবীন-প্রবীণ লেখকরা এতে লিখতেন।

পত্রিকাটির শুরু এবং শেষের দিকে বের হতো ট্যাবলয়েড সাইজে। আর মাঝখানের দীর্ঘ সময়জুড়ে বের হতো ম্যাগাজিন সাইজে। আর শেষের দিকে পাক্ষিক হিসেবে প্রকাশ হতো। শুরু থেকেই পত্রিকাটিতে নিউজ-প্রতিবেদন প্রাধান্য পেত, শেষের দিকে এগুলোর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। তবে সমসাময়িক বিষয় এবং গল্প-উপন্যাস-কবিতাও ছাপা হতো। প্রতি সংখ্যাতেই আলোচিত ও কিছুটা বিতর্কিত বিষয় সামনে এনে একটা উত্তাপ ছড়ানোর চেষ্টা করত। পত্রিকাটি লেখালেখিতে আগ্রহী নবীন-তরুণদের মাঝে বেশ সাড়া ফেলেছিল। তারা আগ্রহ ভরে বিভিন্ন নিউজ-প্রতিবেদন পাঠাত। পরিচয়পত্র সরবরাহের মাধ্যমে দেশব্যাপী সংবাদদাতা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পত্রিকাটির আয়োজনে কয়েকটি সাহিত্য প্রোগ্রামও হয়েছিল। আর্থিক টানাপোড়েনে ২০১৪ সালের শেষের দিকে এটি বন্ধ হয়ে যায়।

সাহিত্যকলি

‘লেখালেখির পথ দেখায়’ স্লোগানকে ধারণ করে ৩৫/৬-এ পূর্ব ইসলামবাগ থেকে বের হতো মাসিক ‘সাহিত্যকলি’। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে পত্রিকাটির পথচলা শুরু হয়। সম্পাদক ছিলেন আহসান শরিফ, সহযোগী সম্পাদক শফিক সাদী। এছাড়া কয়েকজন তরুণ লেখক পত্রিকাটির সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমাদের পরিচিত আলেম লেখক ছাড়াও বিচারপতি আবদুর রউফ, আবদুল হাই শিকদার, আল মুজাহিদী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, মহিউদ্দিন আকবর, সমর ইসলামসহ আরও অনেকে এতে লিখতেন।

এটি গতানুগতিকতা পরিহার করে সম্পূর্ণ সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে প্রকাশের চেষ্টা ছিল। সাহিত্য ও লেখালেখিবিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ফিচার-প্রতিবেদন, ভ্রমণ কাহিনি, গল্প ও কবিতাই এতে প্রাধান্য পেত। কিশোর-তরুণদের উপযোগী করে প্রকাশ করা হতো পত্রিকাটি। নবীন লেখক-পাঠকদের মধ্যে এটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু নিজস্ব আর্থিক ফান্ড না থাকলে যা হয় তাই হলো। পত্রিকা পরিবারের নিজ নিজ কর্মব্যস্ততা এবং যথাযথ বিজ্ঞাপন ও স্পন্সরের অভাবে পত্রিকাটির প্রকাশনা একসময় বন্ধ হয়ে যায়। ২০১২ সালের জুনে এটির সর্বশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। কলি পরিষদ বাংলাদেশ-এর মুখপত্র হিসেবে এটি প্রকাশ পেত।

আলোচিত সবকটি পত্রিকা থেকেই কম-বেশি লেখক বেরিয়ে এসেছিল। পত্রিকাগুলোতে আমিও লিখতাম। অফিসে যাওয়া-আসা হতো, সম্পাদকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় হতো। এজন্য পত্রিকাগুলোর সঙ্গে একটা অন্যরকম ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। ঘুরেফিরেই মনে পড়ে পত্রিকাগুলোর কথা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সাহিত্যকলি ছাড়া বাকি চারটি পত্রিকাই ছিল রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত। তাই আমাদের প্রত্যাশা-অধুনালুপ্ত পত্রিকাগুলোর প্রতিকূলতা কেটে যাক, এগুলোর পথচলা আবার শুরু হোক এবং আরও মসৃণ হোক চালু পত্রিকাগুলোর পথচলা।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম

[লেখা ও লেখকের কথা নিয়ে প্রকাশিত লেখকপত্রের তৃতীয় সংখ্যার সৌজন্যে]


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ