শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


ইমামতির দায়িত্ব ও তার চ্যালেঞ্জ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি আব্দুল্লাহ কাসেমী ।।

ইমামতি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক একটি পদ। রাসুল সা. ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত। উভয় জগতে সফলতা ও কামিয়াবির মাধ্যমও হতে পারে এই ইমামতি। একজন ইমাম হতে পারেন মানবতার পথপ্রদর্শক ও সরল পথের দিশারি। ইমামের সংশ্রবে ধূধূ মরু হয়ে ওঠে সবুজ-শ্যামল। জীবন ফিরে পেতে পারে মৃত হৃদয়। সৃষ্টি ও স্রষ্ঠার মাঝে বন্ধন তৈরি করার নাম হচ্ছে ইমামতি।

ইমামতির পদ উপকারি ও ফায়দাজনক। তবে ঝুঁকিপূর্ণও বটে। ইমামতির কারণে, যে দায়িত্ব ইমামের ওপর আসে, সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ও অসাধারণ। পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিই এই দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করতে পারে। সাথে সাথে ইমামকে হতে হয় উত্তম চরিত্র ও আদর্শের অধিকারী।

এই দুই গুণ শূন্য ইমাম কখনো দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। কেননা যোগ্যতা সম্পন্ন না হলে, মানুষের নামাজ নষ্ট করবে, ভুল মাসয়ালা বর্ণনা করবে। ইমাম চরিত্রবান ও আদর্শবান না হলে মানুষ কষ্ট পাবে। মানুষ, ইমামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সমালোচনা করার সুযোগ পেয়ে নিজেদের ঈমান-আমলকেও খোয়াবে।

শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িয়ে নিজেকে দায়িত্বমুক্ত ভাবা কখনো কাম্য নয়। সমাজ ও মানুষকে নিয়ে ইমামের ভাবতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে মানুষের ইসলাহ ও সংশোধনের প্রতি। প্রথম নামাজের কথাই ধরা যাক। যদি মুসল্লিদের নামাজ সুন্নত মুতাবেক না হয় তাহলে কিছু সময় বের করে সুন্নত মুতাবেক নামাজ শিখাতে হবে।

ফরজ পরিমান কেরাত শুদ্ধ না থাকলে এ ব্যাপারে মেহনত করতে হবে। যারা কুরআন তেলাওয়াত জানে না, তাদের কুরআন শিখার ব্যবস্থা করতে হবে। নামাজের প্রতি অলস ও উদাসীনকে সচেতন করতে হবে। তাকে নামাজের গুরুত্ব বুঝাতে হবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায়ের পাবন্দ বানাতে হবে।

সমাজের কেউ শরিয়ত বিরোধী কাজ করলে আস্তে আস্তে তাকে সংশোধনের চেষ্টা করাও একজন ইমামের দায়িত্ব। ইমামগণ, মুক্তাদীদের মাঝে দীনি বুঝ জাগ্রত করে, আল্লাহ তায়ালার সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক তৈরি করে দিতে পারলে ইনশাআল্লাহ অচিরেই এমন এক সুস্থ ও সুন্দর ইসলামি সমাজ গড়ে ওঠবে, যেখানকার প্রতিটি নাগরিক হবে দীনের সত্য ও একনিষ্ঠ সৈনিক। যারা হবে ইসলামি তাহযীব-তামাদ্দুনের সংরক্ষক।

মসজিদসমূহে সাধারণত সকালের মক্তব চালু থাকে। বাচ্চাদের নূরানী কায়দা থেকে কুরআন শরিফ, মাসনুন দোয়া, দীনের প্রয়োজনীয় ও মৌলিক বিষয় সেখানে শিখানো হয়। ওই বাচ্চারা আমাদের কাছে আমানত। তারা হচ্ছে এ জাতির ভবিষ্যত। এজন্যে ইমামগণের কর্তব্য হচ্ছে, জাতির এই ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা। দীনি শিক্ষায় তাদের শিক্ষিত করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি থেকে তাদের দূরে রাখা। রাঙ্গিয়ে তোলা তাদের জীবন ইসলামের রঙ্গে।

মনে রাখতে হবে, সিরাত হচ্ছে জাতির সফলতার আসল হাতিয়ার। তাই ইমামের দায়িত্ব এটাও যে, বাচ্চাদের চরিত্রকে সিরাতে নববীর খুশবু দিয়ে সুবাসিত করা। তাদের আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। কুরআন হিফজের আগ্রহ তাদের অন্তরে জাগ্রত করা। মসজিদের ইমামগণ মকতবের শিক্ষার্থীদের ওপর মেহনত করলে প্রথমত ছাত্ররা মাদরাসার উপযুক্ত বনে যাবে এবং ছাত্ররা দীনি মেজাজের অধিকারী হবে।

দ্বিতীয়ত ওই ছাত্ররা যদি মাদরাসায় পূর্ণ আগ্রহ ও উদ্দীপনার সাথে শিক্ষা চালু রাখে এবং উপযুক্ত ও অভিজ্ঞ আলেমে দীন হয়ে বের হয়, এরপর তারা নিজেদের এলাকায় দীনের দাওয়াত, ইসলাম প্রচার, অজ্ঞ ও মূর্খ সমাজে ইলম ও আমলের আলো ছড়ায়। তাহলে ইমামের ওই চেষ্টা সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভূক্ত হবে। অনন্তকাল পর্যন্ত সে এর সওয়াব পেতে থাকবে।

ইমাম হবেন ধৈর্য্যশীল, উদার ও আত্মমর্যাদবোধ সম্পন্ন। কেননা, মুসল্লিদের কারও কারও ঝগড়া পছন্দ হয়ে থাকে। এরা অনর্থক ইমামকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু বানায়। সর্বদা ইমাম, মুয়াজ্জিনের দোষ ত্রুটি তালাশ করে। এখন ইমাম সাহেবও যদি তাদের মতো হন এবং রেগে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন তাহলে অবস্থা জটিল আকার ধারন করবে। এলাকায় দলাদলি হবে। মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি নষ্ট হবে।

এজন্যে ইমামের করণীয় হচ্ছে, সর্বাবস্থায় ধৈর্যশীলের পরিচয় দেয়া এবং বিরোধীদের প্রতি উদারতা দেখানো। তাহলে কিছু দিনের মধ্যেই সমালোচকরা ইমামের দোষ বর্ণনা থেকে ফিরে আসবে। মানুষের কাছে ইমাম সাহেবের মান-মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে।

ইমাম হবেন, সরল-সহজ ও ভদ্র স্বভাবের অধিকারী। তবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হওয়াও জরুরি। যার মাঝে উক্ত গুণগুলো বিদ্যমান থাকবে এলাকায় তার দ্বারা পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে যায়। সাধারণ মানুষ তার কথাকে মন থেকে গ্রহণ করে। এর বিপরীত হলে ফল উল্টো হতে বাধ্য।

ইমামের কয়েকটি দুর্বলতা হচ্ছে, নামাজের পূর্বে এবং পরের সুন্নতে মুয়াক্কাদার ব্যাপারে অলসতা ও অমনযোগীতা। স্পষ্ট যে, যখন ইমাম সুন্নতে মুয়াক্কাদার ব্যাপারে অলসতা করবে তখন সাধারণ লোকেরা তো ফরজের মধ্যেও অলসতা করবে। এইজন্য আবশ্যক হলো, ইমাম সুন্নতে মুয়াক্কাদা এবং সুন্নতে গাইরে মুয়াক্কাদা আদায়ের ব্যাপারে গুরুত্ব দিবে।

কিছু মসজিদে এটা দেখা যায় যে, ইমাম সাহেব ফরজ নামাজে লম্বা লম্বা কেরাত পড়ে থাকেন। এতে অনেক সময় মানুষ বিরক্ত হন, কষ্টে পড়েন। এই জন্য ফরজ নামাজে সংক্ষিপ্ত কেরাত পড়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. একবার এশার নামাজে দীর্ঘ কেরাত পড়েন।

একজন অভিযোগ করলে, হুজুর সা. মুয়াজের প্রতি অনেক অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা.কে নামাজ হালকা এবং সংক্ষিপ্ত করে পড়াতে বলেন। কেননা মুসল্লিদের মাঝে এমন কিছু লোক থাকেন যারা দুর্বল ও অতিশয় বৃদ্ধ। যাদের প্রতি খেয়াল রাখাও ইমামের জন্য জরুরি।

ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন প্রসঙ্গ

বর্তমান সময়ে বাজারের অবস্থা সম্পর্কে আমরা সকলেই জানি। তাছাড়া, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থাও অনেক ব্যয় বহুল। বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা সভা-সমাবেশ, বিয়ে শাদি ইত্যাদি অনুষ্ঠানের সময় টাকা হিসেব করে খরচ করি না। মসজিদে দামি দামি ট্রাইলস, দৃষ্টি নন্দন গম্বুজ, উঁচু উঁচু মিনারা ইত্যাদি কাজের জন্য মোটা অংকের দান এবং বদান্যতার প্রকাশ ঘটাই। কিন্তু মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বেলায় দেখা যায় উল্টোটা।

দুনিয়াকে সাজানো হয়েছে আশা-আকাঙ্খা দ্বারা। দুনিয়ার মণি-মুক্তা মানুষদিগকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে থাকে। দুনিয়ার চাকচিক্যতা এবং মনোমুগ্ধকর দৃৃশ্য প্রত্যেক মানুষকে দুনিয়ার দিকে দাওয়াত দেয়। দুনিয়ার ভোগ বিলাস ও সুখ শান্তির সামনে বড় বড় হিম্মতওয়ালারাও দুর্বল হয়ে পড়ে।

তবে হ্যাঁ, খোদায়ী নুসরত যেই ব্যক্তির শামিলে হাল হয় তার কথা ভিন্ন। এ রকম নাজুক পরিস্থিতিতে কোনো ব্যক্তি যদি যুহদ ও অল্পেতুষ্টিকে নিজের বৈশিষ্ট্য বানিয়ে নিতে পারে এবং বস্তুবাদের কাটাযুক্ত আঁচল থেকে বাঁচার চেষ্টা করে, তাহলে তো এই আশা করা যায় যে, তার ঘরের লোকেরাও এই রঙ্গে রঙ্গিন হবে।

এই জন্য মুকতাদি হযরতদের জিম্মাদারী হলো, মসজিদের ইমামগণের জীবন যাপনের স্তরকে উপরে উঠাবে। তারা তাদের এই পরিমান আর্থিক সহায়তা প্রদান করবে, যাতে করে তাদের পরিবারের প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে এবং সে একাগ্রতার সাথে দীনের খেদমত আঞ্জাম দিতে পারে।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘(দান-খয়রাত) সেই গরীবদের জন্য, যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে আবদ্ধ হয়ে থাকে যে, তারা (জীবিকা নির্বাহের জন্য) জমিনে চলাফেরা করতে পারে না। অনবগত লোকেরা সওয়াল না করার কারণে, তাদের ধনী মনে করে। তাদের চেহারা-লক্ষণ দেখে তুমি তাদের চিনতে পারবে।’

এই আয়াতের উদ্দেশ্য ওই সমস্ত লোক, যারা দীনি খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার মাঝে এমনভাবে লিপ্ত যে, জীবিকা উপার্জনের জন্য সময় বের করতে পারে না। তাদের প্রতি খেয়াল করা এবং তাদের জীবনের স্তরকে উঁচু করা উম্মতে মুসলিমার জিম্মাদারি।

ভাষান্তর: শহীদুল ইসলাম (মাসিক আরগুমান-এর সৌজন্যে )

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ