বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


'দাওয়াত সেটাই হবে, যেটা মানুষকে কাছে টানবে'

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

গত ১৫ মে বুধবার  রকমারি ডটকম ও দেশের অন্যতম অনলাইন নিউজপোর্টাল আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম- এর উদ্যোগে আয়োজিত লেখালেখি ও সাংবাদিকতা কোর্স অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোর্সটি সার্বিক তত্বাবধায়ন করছে ‘বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম’। কোর্সের ৯ম দিনে ‘লেখকের আদর্শিক অবস্থান’ বিষয়ে দরস প্রদান করেছেন জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মুহাম্মদপুর এর সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা মামুনুল হক। পাঠকদের জন্য বিদগ্ধ এ আলেমের দেড় ঘন্টাব্যাপী বক্তব্যের সারনির্যাস তুলে ধরা হলো। অনুলিখন করেছেন লেখালেখি ও সাংবাদিকতা কোর্সের শিক্ষার্থী জাবির মাহমুদ


ইসলামে দাওয়াতের অনেক মাধ্যম রয়েছে। এর মধ্যে লেখালেখি দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম বা উপলক্ষ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে একজন লেখকের পরিচয়ের চেয়ে একজন দাঈর পরিচয়ের আলোচনা অগ্রে হওয়ার দাবি রাখে। দাওয়াত হলো, প্রচারণা ও প্রকাশনার মাধ্যমে ইসলামের বার্তা জনগণ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া ও জনমানুষকে এর প্রতি আকৃষ্ট করে সেটাকে গ্রহণ করানো। যদি জনগণ সেটাকে গ্রহণ না করে তাহলে সেটা দাওয়াত হবে না।

আল্লামা রুমি রহ. তার মসনবী শরীফে মুসা আ. সম্পর্কে কিছু পংক্তি লিখেছেন। যার অনুবাদ হলো : ‘মুসা আ. এর কাছে আল্লাহর তরফ থেকে ওহি আসলো যে, তুমি আমার বান্দাকে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন কেনো করলে? সে যেভাবেই হোক, আমাকে নিয়েই তো জল্পনা কল্পনা করছিলো!’

এখানে বক্তব্যের শুদ্ধাশুদ্ধি পরবর্তী বিষয়। কিন্তু আমাদের বলায় ও লেখায় এমন সব বিষয়াদি বর্জন করতে হবে, যার দ্বারা জনগণ আল্লাহবিমুখ হয়!

মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করাকে দাওয়াত বলা হয়। আমরা রাসূল সা. এর আদর্শের প্রচার ও প্রসারের জন্যই বলি বা লিখি। কিন্তু আমার বলা বা লিখার ধরণ কখনো এমন যেনো না হয়ে যায় যে, সেটা দাওয়াতের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

এটা কখনোই দাওয়াত নয়! এজন্যই একটা কিছু লিখে প্রচার করে দেয়ার নামই দাওয়াত নয়। বরং দাওয়াত তো সেটাই হবে, যেটা মানুষকে কাছে টানবে। একজন দায়ীর মেজাজ সম্পর্কে যদি আমাকে বলতে হয় তাহলে আমি বলব যে, আমাদের প্রতিটা বলা ও লিখার মূলে চিন্তাটা এমন থাকবে, যেটা মানুষকে কাছে টানবে। দূরে ঠেলে দিবে না!

একজন দাঈর মেজাজ বা বৈশিষ্ট্য হলো, সে তার লেখায়, কথায় এমনকি তার আচরণেও সবসময় মানুষকে আকৃষ্ট করবে। কাছে টানবে। কুরআন পাকের ইরশাদ, ‘আপনি আপনার সকল উন্মতের জন্য খুব নম্র ও কোমল হয়ে যান। আপনি যদি রুঢ় আচরণের মানুষ হতেন, মানুষেরা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেতো।’

অতএব একজন দাঈর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সে মানুষকে তার কাছে টানবে। তার আদর্শ ও বিশ্বাসের দিকে টানবে। যদি আমার লেখালেখির উদ্দেশ্যটা দাওয়াত হয়, কোনো একটা আদর্শের প্রচার হয়, তাহলে একজন লেখকের মধ্যেও এই দাঈর মেজাজটা থাকতে হবে।

কোনো বিষয়ে লিখার সময় দাঈর মেজাজের মধ্যে এ চিন্তা থাকতে হবে- ‘আমি যে লিখব, এতে করে আমার শব্দটা প্রতিষ্ঠিত হবে ঠিক! কিন্তু এই শব্দটা কি মানুষ গ্রহণ করবে? নাকি মানুষ দূরে সরে যাবে?’

একটা জিনিস প্রমাণ করে দেয়াই কিন্তু শেষ কথা নয়! বরং একটা জিনিস মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলাটাই হচ্ছে বড় বিষয়! একটা বড় পার্থক্য আছে এখানে। যেমন: তুমি অপরাধী, আমি বিষয়টাকে প্রমাণ করে দিলাম। এর দ্বারাই কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো না! বরং আমি যদি তোমাকে লেখার মাধ্যমে অনুশোচনা জাগাতে পারি, তাহলেই আমার উদ্দেশ্য সফল হবে।

একজন মানুষকে শুধু শুধু অপরাধী প্রমাণ করে তো লাভ নেই, যদি এর দ্বারা তার মধ্যে কোনো সংশোধনের অনুশোচনা না আসে! যদি তাকে অপরাধী প্রমাণের মাধ্যমে তার ভিতরে সংশোধনের অনুশোচনা আসে বা সংশোধনের অনুভূতি সৃষ্টি হয় তাহলেই সে লেখায় স্বার্থক হওয়া যাবে।

এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে আমাদের মধ্যে যে প্রবণতাটা কাজ করে সেটা হলো, আমরা যে কোনো বিষয়কে প্রমাণ করার দিকে যতোটা মনোযোগী, সেটাকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য ঠিক ততোটা অমোনযোগী নই! এই বিষয়টা বলা এবং লেখা উভয় ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।

কলম চলছে তো চলছেই, আমি আমার প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করে দিচ্ছি। নিজে খুব উৎফুল্ল হচ্ছি, আমার আপনজন, আমার সমর্থকেরা এতে খুবই উৎসাহ বোধ করছেন এই ভেবে যে ‘আমি তাকে লা জাওয়াব করে দিলাম।’ এটা তো হলো আমি তাকে অপরাধী প্রমাণ করলাম মাত্র! তাকে তো কোনোকিছু গ্রহণ করাতে পারিনি।

আল্লামা তাকি উসমানির এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ একটা ঘটনা আমরা স্মরণ করতে পারি- ‘তিনি ছাত্র বয়স থেকেই লেখালেখি করতেন। পরবর্তীতে ফারাগাতের পর তিনি একটা মতানৈক্যপূর্ণ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে পিতাকে দেখান।

তখন তার পিতা বলেন, যদি তুমি এর দ্বারা তোমার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চাও, তাহলে এরচে' ভালো রচনা আর হয় না! কিন্তু এর দ্বারা প্রতিপক্ষ ঘায়েল হবে ঠিক, তবে সে তোমার মতামতকে কোনোদিনই গ্রহণ করবে না! আর যদি প্রতিপক্ষের হেদায়াতের প্রত্যাশী হও, তাহলে তোমার এই লেখা কিছুই হয়নি!

এরপর থেকে আল্লামা তাকি উসমানির লেখালেখির মোড় ঘুরে যায়! এবং আজও তিনি সেই পরিবর্তীত ধারায় লিখে যাচ্ছেন। লেখকের মেজাজটা হতে হবে এমন যে, আমার লেখার দ্বারা, আমার কলমের খোঁচায় কাউকে রক্তাক্ত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি তো চাই আমার কলম থেকে প্রেম ভালোবাসার কথাগুলো কালির হরফ হয়ে ঝরুক।

আমাদের মেজাজের মৌলিক লক্ষ হবে দাওয়াত। আর দাওয়াত মানে শুধু সত্যকে প্রমাণিত করা নয়, সত্যকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। প্রমাণিত আর গ্রহণযোগ্যতার মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে। নিজের আদর্শকে প্রমাণিত করারচে' গ্রহণযোগ্য করে উপস্হাপন করাটাই হচ্ছে বেশি প্রয়োজন।

হাদিসে আছে- প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ীকারীই প্রকৃত বীর নয়, বরং প্রকৃত বীর হলো সেই ব্যক্তি যে প্রচন্ত ক্রধের সময়ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

এর ফলাফল এটা দাঁড়াবে যে, মানবিক স্বভাবের কারণে আমরা অনেক সময় উত্তেজিত হয়ে থাকি। তখন আমরা রাগের বশে কিছু লিখব না! এতে করে আমাদের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে। মনের কথাটা সরলভাবে ব্যক্ত করতে পারার সাধনাটা প্রতিটা লেখকেরই করতে হবে।

এজন্য একটা লেখা লিখে সেটাকে সহজীকরণের জন্য বারবার দেখা। কারণ লেখাটা যতো বেশি সহজ হবে সেটা পাঠককে ততো বেশি আকৃষ্ট করবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি আমার ‘কারাগার থেকে বলছি’ বইটিকে একটি সফল বই বলি। এবং হূমায়ুনের প্রাঠক প্রিয়তার পেছনে এই ব্যাপারটাই মূল বলে আমি মনে করি।

লেখকের জন্য তার আদর্শিক জায়গাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো, শেকড়কে ধরে রাখা। এটা করতে পারলে আমাদের উন্নতির কোনো শেষ নেই। আমি যতোই উন্নত হই না কেনো, আমার শেকড় ছিন্ন হয়ে গেলে সবই বৃথা। যেমন: আকাশে উড়তে থাকা কোনো নাটাইওয়ালা ঘুড়ি। কিংবা মাটি কামড়ানো শেকড়ের বিশাল বটগাছ। ঘুড়ির নাটাই আর গাছের শেকড়টা ছিঁড়ে গেলেই সব শেষ! এর শোভা, নন্দন সবকিছু নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে।

লেখালেখিটা অনেক সেনসিটিভ জায়গা। আর এক্ষেত্রে আদর্শচ্যুত হয়ে যাওয়াটা আমাদের বড় দূর্বলতা। অনেক উন্নতির পরও শেকড়ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে আমরা হারিয়ে যাই। আমরা আর আমাদের থাকি না!

আরএম/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ