শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


মাওলানা মুহাম্মদ সালমান: ইসলামি কর্মময়দানে এক নীরব বিপ্লবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী ।। 

রূহের জগতে মহান আল্লাহর কাছে দেয়া অঙ্গীকার ভুলে যুগে যুগে মানুষ যখন গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছে, তখন পথভোলা বিপথগামী এ মানুষগুলোকে সেখান থেকে উদ্ধার করে ‘সিরাতে মুসতাকীম’ এর দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য আল্লাহ তাআলা তাঁর নির্বাচিত ও মনোনীত কিছু মানুষকে নবি-রাসুলরূপে প্রেরণ করেছেন এ দুনিয়ায়। সে ধারাবাহিকতারই শেষ নবি হলেন হযরত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর পর আর কোনো নবী আসবেন না বিধায় সে মহান দায়িত্ব বর্তেছে তাঁরই ওয়ারিশ ও আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা উলামায়ে কেরামের ওপর।

আর উলামায়ে কেরাম সে দায়িত্বের ভার কাঁধে নিয়ে দুনিয়ার আরামা-আয়েশ ও ভোগ-বিলাস বিসর্জন দিয়ে এগিয়ে গেছেন মনযিলে মকসুদ পানে। আলোকিত সে কাফেলারই অন্যতম এক রাহবার হলেন ক্ষণজন্মা মনীষী, বাংলাদেশর বিদগ্ধ ইসলামী চিন্তাবিদ, প্রখ্যাত আলেমেদীন এবং বিংশ শতাব্দীর মুফাক্কিরে ইসলাম শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর প্রিয়ভাজন খলীফা ও বাংলাদেশে তাঁর ভাষ্যকার হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার নলতা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী মাওলানা মুহাম্মদ সালমান জ্ঞান অর্জন করেন স্কুল কলেজ ও মাদরাসা উভয় ধারায়। জ্ঞান আহরণের প্রতি তার গভীর আসক্তি ছিলো জন্মগত। বই পড়া ও বই সংগ্রহ করা ছিলো তার নেশা। হাজারো ফুল থেকে মৌমাছির মধু আহরণের ন্যায় তিনি জ্ঞান আহরণ করেন হাজারো জ্ঞান ভান্ডার থেকে।

কলেজ জীবন শেষ করে দীনি ইলম শিক্ষা করার জন্য তিনি ভর্তি হন গওহরডাঙ্গা মাদরাসায়। তারপর ঢাকার লালবাগ মাদরাসা হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান ভারতে। প্রথমে উপস্থিত হন দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা লাখনৌতে বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ও আধ্যাত্মিক রাহবার শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর সান্নিধ্যে। যাকে তিনি আবিস্কার করেছিলেন তার বইয়ের মাধ্যমে গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় পড়াকালে। এরপর দিন যত গেছে ততই তাঁর প্রতি তার আগ্রহ ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তার সান্নিধ্যের জন্য পাগলপারা হয়েছে। এতদিনে তার পিপাসা নিবারণ হলো।

হযরত নদভীর হাতে বাইআত হয়ে নিজেকে সঁপে দিলেন তার করকমলে। বেশ কিছুদিন তার সোহবতে অবস্থান করে নদওয়াতুল উলামায় ভর্তি জটিলতায় হযরতের দুয়া নিয়ে চলে যান গাঙ্গুহ মাদরাসায়। সেখানে কয়েক বছর অধ্যয়ন করেন চলে আসেন দারুল উলূম দেওবন্দে। এই দারুল উলূম দেওবন্দেই তিনি যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসীনের নিকট হাদীস শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।

এরপর সাহারানপুর মাদরাসায় উপস্থিত হয়ে শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া রহ. এর কাছ থেকে হাদীসে মুসালসালাতের সনদ গ্রহণ করেন এবং তাঁর খেদমতের সৌভাগ্য লাভ করেন। এরপর আধ্যাত্মিক দীক্ষা পূর্ণ করার জন্য ছুটে আসেন রাইবেরেলীর অদূরে সাঈ নদীর তীরে শহীদে বালাকোট হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ. এর বসতভিটায় তার পীর ও মুরশিদ শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর খানকায়।

সহজাত বিনয় ও খেদমতী গুণের মাধ্যমে তিনি অল্পদিনেই শায়খ নদভীর সুদৃষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হন। শায়খ নদভীর নাতি মাওলানা মাহমূদ হাসানী বলেন, মাওলানা সালমান রাইবেরেলীতে আসলে এক মনোমুগ্ধকার পরিবেশের সৃষ্টি হতো। আমাদের পরিবারের সদস্য ও খাদেমগণ তার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হতেন। আলী মিয়া নদভী রহ. তার এ প্রিয় মুরীদের প্রতি বিশেষ সুদৃষ্টি দিতেন এবং সর্বাবস্থায় কাছে রাখতেন। পাশে বসিয়ে খাবার খেতেন, নামাজে পাশে রাখতেন, দরস ও বয়ানের সময় পাশে বসাতেন।’

এভাবে শায়খ নদভীর ছায়ায় দীর্ঘ মেহনত ও মুজাহাদার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার সকল মানজিল অতিক্রম করেন মাওলানা মুহাম্মদ সালমান। এক পর্যায়ে মুফাক্কিরে ইসলাম শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. তাকে তার খেলাফত প্রদান করেন। এরপর তিনি আর পিছে ফিরে তাকাননি। যে দায়িত্বের বোঝা শায়খ নদভী তার স্কন্ধে চাপিয়ে দিয়েছেন তা নিয়ে তিনি ছুটে চললেন পাগলের মতো, এখনো চলছেন।

তিনি বাংলাদেশে শায়খ নদভীর তরজুমান ও ভাষ্যকার হিসেবে ইতোমধ্যেই পরিচিতি লাভ করেছেন। তার হাত ধরেই বাংলাদেশে শায়খ নদভীর চিন্তাধারার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। শায়খ নদভীর ইন্তেকালের পর তিনি বায়আত রুজু করেন তারই স্থলাভিষিক্ত খলীফা ও ভাগ্নে মুরশিদুল উম্মাহ শায়খ মুহাম্মাদ রাবে’ হাসানী নদভীর হাতে।

মাওলানা মুহাম্মাদ সালমানের আরেক পীর হলেন সদর সাহেব হুজুর খ্যাত হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.। হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.-কে নিজ চোখে না দেখলেও তিনি তার রূহানী মুরিদ। তিনি হযরত সদর সাহেব হুজুরের জন্য কত যে পাগলপারা যা তার আশেপাশের লোকজন সহজেই অনুমাণ করতে পারেন। ধ্যান-খেয়ালে শুধুই সদর সাহেব হুজুর। যর প্রেমে তিনি রচনা করেছেন সুবিশাল ভলিউমের ‘আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. স্মারকগ্রন্থ’।

মাওলানা মুহাম্মদ সালমান তার কাছের লোকজনদের কাছে বলেন, ‘আমার আসল পীর সদর সাহেব হুজুর। তার চিন্তা-চেতনাই আমার চিন্তা-চেতনা। স্বপ্নে আমি তার হাতে বাইআত হয়েছি। হাইস্কুলে পড়াকালীন সময়েই আমি তাকে আবিস্কার করি। এরপর গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় এসে ভর্তি হই।’

এজন্যই মাওলানা মুহাম্মাদ সালমানের সকল কর্মতৎপরতার মধ্যে হযরত সদর সাহেব হুজুরের দরদ, চিন্তা ও চেতনার একটা ছাপ ফুটে ওঠে। অনেকেই নিজেকে সদর সাহেব হুজুরের বড় বড় খাদেম ও শাগরিদ দাবী করে থাকেন এবং তার দিকে নিজেকে নিসবত করেন, কিন্তু সদর সাহেব হুজুরের আসল কাজ করেন মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান।

শতাব্দীর ইতিহাসে সফল মনীষীবৃন্দের আবির্ভাব খুব একটা বেশি হয় না। যাদের শিক্ষা-দীক্ষা, কর্মউদ্যোগ ও চারিত্রিক মাধুর্যে আকৃষ্ট হয়ে বিভ্রান্তির গহ্বরে আবর্তিত দিকহারা মানবজাতি সঠিক পথে চলার নির্দেশনা পায়। সমকালীন সময়ে বাংলা অধ্যুষিত অঞ্চলে যে ক’জন খ্যাতনামা মনীষী যুগোপযুগী ইসলামি শিক্ষার বিস্তার, দীনি দাওয়াত সম্প্রসারণ, ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের বৃদ্ধিবৃত্তিক হামলা মোকাবেলা এবং আত্মশুদ্ধির মেহনত ও মানবসেবার মাধ্যমে ইসলামের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন; মাওলানা মুহাম্মদ সালমান তাদের একজন।

বাংলাদেশের সমকালীন অন্যতম চিন্তাশীল আলেম, ব্যতিক্রমধর্মী পন্ডিত, আধ্যাত্মিক রাহবার, সত্যানুসন্ধানী ইসলামি চিন্তাবিদ ও উম্মাহর দরদী দাঈ মাওলানা মুহাম্মদ সালমান বহুমুখী গুণের অধিকারী এক ক্ষণজন্মা মনীষী। দরদী অন্তর ও যুগোপযুগী চিন্তার অধিকারী মাওলানা মুহাম্মদ সালমানের দীনি তৎপরতা বাংলা অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহের মুসলিম মানসে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।

তিনি একাধারে একজন বিদগ্ধ সৃজনশীল লেখক, দক্ষ অনুবাদক, সাহিত্যিক, গবেষক, দাঈ, শিক্ষাবিদ, সংগঠক, প্রতিষ্ঠান পরিচালক, আধ্যাত্মিক রাহবার এবং দীনি দাওয়াত ও তাবলীগের অনন্য পথিকৃৎ।

গত শতকের আশির দশকে তিনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মিরপুরে গড়ে তোলেন ইসলামী শিক্ষার ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান ‘মাদরাসা দারুর রাশাদ’। বিগত ত্রিশ বছর যাবত তার দক্ষ ও সফল পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বময় সুনাম সুখ্যাতি অর্জন করেছে।

এরপর তিনি আধুনিক শিক্ষা ও মাদরাসা শিক্ষার সমন্বিত সিলেবাসে গড়ে তোলেন জামেয়াতুর রাশাদ আল-ইসলামিয়াহ। যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা একই সাথে মাদরাসার দাওরায়ে হাদীস ও সরকারী সিলেবাসের বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বিশ্বব্যাপী চলমান বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক, মিডিয়া ও লেখনি আগ্রাসন মোকাবেলায় একদল যুগসচেতন আলেমেদীন গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী এডুকেশন সেন্টার ও ইদারাতুল মাআরিফ।

যেখান থেকে শত শত দাওরায়ে হাদীস পাস আলেম সাহিত্য ও সাংবাদিকতা কোর্স এবং দাঈ ও মুবাল্লিগ কোর্স সম্পন্ন করে ইসলামের যুগোপযুগী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। এভাবে তিনি বাংলাদেশে তার শিষ্য-শাগরিদের এক বিশাল বহর গড়ে তুলেছেন। যারা বাংলাদেশে সাহিত্য-সাংবাদিকতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে।

ঢাকার অদূরে বিরুলিয়ায় তিনি গড়ে তুলেছেন ‘খানকায়ে আলী মিয়া নদভী রহ. ও সাবীলুর রাশাদ ট্রাস্ট’। যার মাধ্যমে তাযকিয়া ও খেদমতে খালক তথা আত্মশুদ্ধি ও মানবসেবার খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি একজন আপদমস্তক মানবতাবাদী পীরে কামেল। খানকার পাশেই গড়ে তুলেছেন উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার।

বর্তমানে তিনি হাতে নিয়েছেন ‘সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার কাজ। এ ছাড়াও তিনি বহু দীনি, শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্য ও সেবামূলক সংগঠন, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক হয়ে দেশময় এক নীরব বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।

মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান নিরলস জ্ঞান-সাধক, এক ক্লান্তিহীন যোদ্ধা। তিনি সেই ছাত্র জীবন থেকে যে কলমী, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও দাওয়াতী যুদ্ধে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তা থেকে কোনো দিন এক মুহূর্তের জন্যেও বিরত হননি। তার কর্মযজ্ঞের দিকে তাকালে যে কেউ অনুমাণ করতে পারেন তার জ্ঞান ও চিন্তার গভীরতা। জ্ঞানের সমুদ্র থেকে কত শত মণি-মুক্তা আহরণ করে যে তিনি উম্মাহর সামনে তুলে ধরেছেন পরম আগ্রহের সাথে, যা তার ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত লিটারেচার ও রচনাবলী দেখলে সহজেই অনুমাণ করা যায়।

মৌলিক ও অনুবাদ মিলিয়ে প্রায় শতাধিক অতি মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করে তিনি বাংলায় ইসলামী সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ এবং ইসলামী চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি বাংলায় সঠিক ইসলামি চিন্তাধারা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন এবং যা চিন্তাশীল পাঠক সমাজের চিন্তা-চেতনাকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। তিনি ওরাছাতুল আম্বিয়ার এক মূর্তপ্রতীক।

যুগে যুগে ওরাছাতুল আম্বিয়ার নিষ্ঠাবান সংগ্রামী সাধক ওলামা-মাশায়েখ যেভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দীনি দাওয়াতের প্রচার প্রসার ও তা সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠাকল্পে নিরলস সাধনা করেছেন এবং সকল প্রকার প্রতিকূলতার মাঝেও অসীম ধৈর্য্য সহকারে আপন দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে অটল-অবিচল ভূমিকা পালন করেছেন, মাওলানা মুহাম্মদ সালমান সে ধরনেরই একজন উঁচু পর্যায়ের বিচক্ষণ সাধক আলেম ও ইসলামের দরদী দাঈ।

ইসলামের প্রচার প্রসার এবং তার দা‘ওয়াত ও তাবলীগের কাজে তিনি খুবই আন্তরিক। তিনি একজন মহান দাঈ ও চিন্তক। ‘শ্রেষ্ঠ উম্মত’ হিসেবে উম্মতে মুহাম্মদীর উপর যে গুরু-দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে তা পালন, উম্মাহর মন-মানস গঠন, তাদের মধ্যে ‘ঈমানী জাগরণ’ সৃষ্টি ও তাদেরকে নব-চেতনায় উদ্দীপ্ত করার ক্ষেত্রে মাওলনা মুহাম্মান সালমানের এক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।

তার দাওয়াত ও চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করলে যেসব তত্ত্বকথা ও মর্মবাণী ফুটে উঠে তা হলো—এক. পশ্চিমা সভ্যতার আগ্রাসন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, দুই. পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও লিখনী আগ্রাসন মুকাবিলায় কার্যকর কর্মপন্থা গ্রহণ, তিন. আধ্যাত্মিকতার জ্বলন্ত অঙ্গারকে উত্তাপময় করা, চার. বিনাশ নয়—নির্মাণ, বিভক্তি নয়—ঐক্য, পাঁচ. আল্লাহর পথে জিহাদের প্রাণ সঞ্চার করা, ছয়. ইসলামের সোনালী ইতিহাসের পুনর্জাগরণ, সাত. যুগ সচেতন আলেম-উলামা ও আল্লাহওয়ালা দাঈ তৈরি করা, আট. অমুসলিমদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণ, নয়. ধর্মহীন সাহিত্যের মুকাবিলা ও ইসলামি সাহিত্যের বিকাশ এবং দশ. দীনি শিক্ষার বিকাশ ও বিস্তার। এগুলো শায়খ মুহাম্মাদ সালমানের দাওয়াত ও চিন্তাধারার তত্ত্বকথা ও মৌলিক বিষয়।

শায়খ মুহাম্মাদ সালমান অসংখ্য সৎ গুণাবলীর আধার। তার চারিত্রিক মাধুর্য ও সৌন্দর্য তার মহত্ব ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রমাণ বহন করে। সদালাপী ও সদা হাস্যোজ্জ্বল এ ব্যক্তিকে সহজে অন্যদের থেকে আলাদা করা যায়। অল্প সময়ের মধ্যে মানুষকে আপনজনে পরিণত করার তার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে।

তার গুণাবলী অন্যদের থেকে তাকে আলাদা ব্যক্তি সত্তায় গড়ে তোলে। দীন ও মানবতার প্রতি তার দরদ ও ভালোবাসা অপরিসীম। উম্মাহ ও মানবতার কল্যাণ চিন্তায় পেরেশান ও অস্থির থাকেন সময় সময়। তার ভেতরের মনটি বিশাল বড় ও উদার। তিনি অত্যন্ত মহৎ ও উদার হৃদয়ের মানুষ।

নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান করে অন্যকে সবসময় বড় করে তুলে ধরেন এবং সব মানুষ সম্পর্কেই সুধারণা পোষণ করেন। কারো প্রতি তার কোনোরূপ রাগ-ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিশোধ স্পৃহা ও পরশ্রীকাতরতার লেশমাত্র নেই। কাউকে কষ্ট দেয়া তিনি পছন্দ করেন না। কেউ তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা ঘৃণা করলেও তিনি তার জবাব দেন না এবং নিজের সাথীদেরকেও কোনো প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নিষেধ করেন।

তিনি ইখলাসের মূর্তপ্রতীক। ইখলাস ও আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজের ময়দানে নেমে আসেন এবং সফলতার সাথে সব কিছু সমাধান করেন। তার ইখলাস, বিনয় ও সরলতার কাছে শেষ পর্যন্ত সবাই হার মানতে বাধ্য হয়। তিনি আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত। দুনিয়াবী ভোগ-বিলাস তাকে কোনো সময় স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল না হলেও ধন-সম্পদ ও পদের প্রতি লোভ এবং প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত। পরিবার ও নিজের জন্য কখনো ভোগবাদে বিশ্বাস করেননি, বরং ত্যাগের মধ্যেই জীবনের শান্তি খোঁজেন।

বিনয় ও নম্রতা তার চরিত্রের বড় ভূষণ। তাকে কেউ কোনো সময় অহংকার করতে দেখেনি। নিজের মধ্যে কখনো আমিত্ব ও বড়ত্ব প্রকাশ করেন না। বাংলাদেশে ইসলামি ক্ষেত্রে বড় ধরনের খেদমতের সুযোগ হলেও নিজ থেকে কখনো তা প্রকাশ করেন না। নিজের আচার-আচরণে এতটা বিনয়ী যে, ছোটদের সাথেও এমন আচার-ব্যবহার করেন যেন মনে হয় তাদের থেকে কিছু শিখছেন।

সাদাসিধা পোশাকের অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র আচরণের অধিকারী মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান যে সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর খলীফা ও তার চিন্তার তরজুমান কেউ না জানলে তার কথা বা আচরণে বোঝার উপায় নেই। তিনি শায়খ নদভীর খলীফা পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করেন।

তিনি সব সময় মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে উৎসাহ দেন। কারো মধ্যে কোনো প্রতিভা থাকলে তা তিনি ফুটিয়ে তোলেন এবং উৎসাহ দেন। এভাবে তার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে বহু কর্মবীর মানুষ তৈরি হয়েছে। তিনি তরুণদের প্রতি বিশেষ অনুরাগী। তার পরামর্শ ও নির্দেশনা পেয়ে অনেক তরুণ লেখালেখি, সৃজনশীলতা ও কর্মের ময়দানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

তিনি যার মধ্যে যে যোগ্যতা দেখেন সে অনুযায়ী প্রশংসা ও পরামর্শ দিয়ে তাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দেন। তার মধ্যে লৌকিকতা, কৃত্রিমতা বা ভনিতা বলতে কিছু নেই। তার গোটা জীবনই অকৃত্রিম, খোলামেলা ও আন্তরিকতায় পূর্ণ। নিজের পরিচয় প্রদানে পদমর্যাদাকে কখনো গুরুত্ব দেননা। ছোট বড় এমনকি নিজের অধীনস্থ কর্মচারীদের সাথেও কথা বলার সময় কৃত্রিমতার আশ্রয় নেন না।

তিনি একজন অতিথিপরায়ণ ও মেহমানপাগল মানুষ। তার নিকট প্রতিদিন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর মেহমান আসেন। তিনি মেহমানদের মর্যাদা ও তার সামর্থ্য অনুযায়ী মেহমানদারী করতে ত্রুটি করেন না। কোনো মেহমান এলে প্রথমেই তার খানাপিনা ও আরাম-আয়েশের খোঁজ-খবর নেন।

তিনি সব ধারার আলেমদের নিকট গ্রহণযোগ্যতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সকলেই তার নিকট পরামর্শ নিতে আসেন। খোদাভীতি ও পরহেজগারিতায় তার তুলনা নেই। পরহেজগারী, তাক্বওয়া ও তাহাজ্জুদ তার নিত্য দিনের সঙ্গী। তার প্রতি কেউ কোনো ইহসান করলে তিনি তা কখনো ভুলেন না, বরং বারবার তা বিভিন্ন মজলিসে পুনর্ব্যক্ত করেন এবং আল্লাহ পাকের শোকর আদায় করেন।

তার গোটা জীবন তৃপ্তি, কৃতজ্ঞতা আর শোকরগুযারীর মূর্ত অভিব্যক্তি। যদি তার কবিতা লেখার অভ্যাস থাকতো তবে তিনি হয়তো তা প্রকাশ করতেন এভাবে—

‘প্রচুর দিয়েছো প্রভু আর কিছু নহে মোর চাওয়া
এবার লক্ষ্য মোর তোমার সকাশে চলে যাওয়া।’

এসব গুণাবলীর আলোকে বোঝা যায়, শায়খ মুহাম্মদ সালমান একজন মহামানব। একজন মহামানবের জন্য যতগুলো গুণ থাকা প্রয়োজন তার সবগুলোই তার মধ্যে বিদ্যমান আছে। তার গুণাবলীর কারণে তাকে সহজেই অন্যদের থেকে আলাদা করা যায়। এমন গুণাবলীর মানুষ খুব বেশি একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। কিছু গুণ আল্লাহ তাকে নিজ দয়ায় দান করেছেন। যারা এসব গুণাবলী অর্জন করতে সক্ষম হন, অবশ্যই তারা যুগের মহামানবে পরিণত হন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক আলেম ও বিদগ্ধজন বিভিন্ন ধরনের অবদান রাখছেন, কিন্তু মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান এ দেশের প্রেক্ষাপটে যুগোপযুগী ইসলামি শিক্ষার বিস্তার, ইসলামের সঠিক চিন্তাধারার বিকাশ, দীনি দাওয়াত সম্প্রসারণ, ইসলামের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক হামলা মোকাবেলা, আধ্যাত্মিকতার মেহনত ও মুজাহাদা এবং ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সাহিত্যের বিকাশে একটি নিরব বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। যা যুগ যুগ ধরে বাংলা অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষদেরক আলোড়িত করবে।

লেখক — পরিচালক, শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বিরুলিয়া, ঢাকা।

আরএম/


সম্পর্কিত খবর