মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫


মৃত্যুকে যেভাবে আলিঙ্গন করেন প্রিন্সিপাল হাবীব রহ.

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ মাহবুবুল হক

১৯ অক্টোবর। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত। রাতটি ছিলো বেদনা ও শোকের। সে রাতে বাংলার আকাশ থেকে খসে পড়ে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। থেমে যায় একটি বিপ্লবী কণ্ঠ। শোকে কাতর আমরা ছিলাম বাকরুদ্ধ, মর্মাহত। দেশবাসী হারান আহলে হকের বলিষ্ঠ কণ্ঠ স্বর একজন বীর মুজাহিদকে।

বরকতময় শুক্রবারের রাত। ঘড়িতে তখন রাত ১২:৩০ মিনিট। প্রিন্সিপাল হুজুরের নিয়মিত অভ্যাস অনুযায়ী রাতে ঘুমাবার পূর্বে অজু করে নিদ্রা যাওয়ার আমল ছিলো। সেদিনও তিনি অজুর জন্য বাথরুমে গেলেন।

অজু করে ফিরে আসার পথে মাথা ঘুরানো শুরু হলে তিনি পরিবারের সদস্যদের বললেন, আমাকে শুয়াও। এই শয়নই যে চিরনিদ্রার শয়ন-এটা কে জানতো। শুয়ানোর পরই তিনি অদৃশ্যের কোনো আগন্তুককে লক্ষ্য করে সালাম দিলেন এবং আল্লাহ আল্লাহ যিকির মুখে জপতে থাকেন।

এরপরই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পাড়ি জামান অনন্তকালের জগতে আল্লাহর সান্নিধ্যে। মৃত্যুর যন্ত্রণা ছাড়াই মুখে আল্লাহর নাম নিয়ে মৃত্যুর ফেরেশতাকে স্বাগত জানিয়ে জুমুআর রাতে মৃত্যকে আলিঙ্গন করার এত সুন্দর আয়োজন আল্লাহর নিকটতম বান্দাদের সৌভাগ্যেই শুধু লেখা থাকে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুকরিয়া মাহফিল ৫ নভেম্বর

আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ মৃত্যুকে ভয় পান না। মৃত্যুর জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকেন। হাসি মুখে মৃত্যুকে বরণ করে নেন। মাওলার সাথে মিলিত হতে তাঁদের প্রাণ ব্যাকুল থাকে।

হাদিসের ভাষ্যমতে, হজরত জাবির রা. সূত্রে বর্ণিত, ‘যে মুমিন ব্যক্তি জুমুআর দিন বা জুমুআর রাতে মৃত্যু বরণ করেন, তাঁকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা করা হয় এবং তিনি কেয়ামতের দিন শহীদদের চিহ্ন- নিদর্শনসহ উত্থিত হবেন।’ [আবু নুয়াইম (৩/১৫৫)]

মৃত্যুর পূর্বে হাইপ্রেসার, ডাইবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি। দেশে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি উন্নত চিকিৎসার জন্য ৬ অক্টোবর ২০১৮ শনিবার দুপুর ১টায় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছান।

পরে বিকাল ৫টা ৩০ মিনিটের সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। সেখানে একটি হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিবির পর্যবেক্ষণে থেকে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে ১৬ অক্টোবর মঙ্গলবার সিলেটের বাসায় ফিরে আসেন।

ভারতে চিকিৎসাধীন দিনগুলোতে দেশে আসার তীব্র টান অনুভব করে সঙ্গে থাকা তাঁর ২য় ছেলে মুফতি আব্দুর রহমান ইউসুফ ও জামেয়া মাদানিয়ার শিক্ষক মুফতি ফেদাউর রহমান দিদারকে দেশে নিয়ে আসার জন্য জোর তাগিদ দেন।

এদিকে তাঁর শারিরিক অবস্থাও উন্নতির দিকে অনুভব হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শক্রমে সিলেটে চলে আসেন। বুধবার, বৃহস্পতিবার পুরনো অভ্যাস মতো মাদরাসায় ও আসা-যাওয়া করেন।

জামেয়া মাদানিয়ার শিক্ষক মাওলানা আব্দুল খালিক জানান, প্রিন্সিপাল হুজুর বৃহস্পতিবারে মাদরাসায় আসলে আমি ১ম সাময়িক পরীক্ষার ছুটির নোটিশে স্বাক্ষর করার জন্য নিয়ে গেলে, হুজুর তাতে স্বাক্ষর করেন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২:৩০ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন।

১৯ অক্টোবর শুক্রবার। বেলা ৩.৩০ মিনিটে সিলেট সরকারী আলীয়া মাদরাসা মাঠে প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান রহ.এর জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় ইমামতি করেন তাঁর ২য় ছেলে মুফতি আব্দুর রহমান ইউসুফ।

বৃহত্তর সিলেটের গ্রামে গ্রামে মসজিদের মাইকে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ জানানো হলে এক নজর ভালবাসার প্রিন্সপালকে দেখার জন্য ছুটে আসেন নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ।

সকাল ৯টায় জামেয়া মাদানিয়া ক্যম্পাসে তাঁর মরদেহ রাখা হয়। সেখানে সুশৃংখলভাবে সাধারণ জনতা শেষ বারের মতো জলে ভেজা চোখে তাঁদের প্রিয়মুখকে দেখেন।অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। জুমুআর নামাজের পর প্রিন্সিপাল রহ.কে বহনকারী লাশবাহী গাড়ি জামেয়া মাদানিয়া থেকে সিলেট সরকারি আলিয়া মাঠে পৌঁছে।

কওমি মাদরাসা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার – বিস্তারিত জানুন

জানাযার নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৩০মিনিট আগেই আলীয়া মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। পরে আশেপাশের সড়কগুলোতে জানাযার কাতার বৃদ্ধি হতে থাকে। এক পর্যায়ে জনস্রোতের কাতার বন্দি হতে থাকে উত্তরদিকের আম্বরখানা ও দক্ষিণ দিকের জল্লারপাড়, পূর্বদিকের নয়াসড়ক, পশ্চিম দিকের রিকাবী বাজার পর্যন্ত।

অনুমান করে অনেকেই বলছেন, প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণ করেন। তাঁর জানাযা দেশের বৃহত্তম জানাযাগুলোর অন্যতম। জানাযার নামাজের পূর্বে তাঁর দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়াও আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, আন্জুমানে আল ইসলাহসহ দেশের ও সিলেটের শীর্ষ আলেমরা প্রিন্সিপাল রহ. এর বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে স্মৃতিচারণ করে অনুভূতি ও মূল্যায়ন পেশ করেন।

তাঁর জানাযাই প্রমাণ করে এ মাটি ও মানুষের কাছে তিনি কতটা প্রিয় ছিলেন। সিলেটবাসী শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও চোখের জলে এভাবেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোসহীন এই সিপাহসালারকে চিরবিদায় জানান।

দাফন:  শুক্রবার। বাদ আসর। প্রাণ উজার করে গড়া, জীবনের স্বপ্ন সাধনার ফল জামেয়া মাদানিয়ার ক্যাম্পাসে প্রিন্সাপালের কার্যালয়ের পাশে ফুল বাগানে তাঁকে কবর দেয়া হয়।

আন্দোলন সংগ্রামের উৎসভূমি এ মাটিতেই তাঁকে চিরদিনের জন্য সমাহিত করা হয়। আল্লাহ! তাঁর কবরকে জান্নাতের বাগিচায় পরিণত করুন। আমীন।

লেখক: শিক্ষক জামিয়া ফারুকিয়্যা সিলেট

সিলেটের আলেম জনতা মেয়র সাংসদ, জলে ভেজা সবার চোখ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ