শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


ফেকাহবিশারদ নারীগণ ও তাদের পরিচালিত পাঠ্যসভা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মূল : মিন্নাহ তিললাওয়ি
অনুবাদ : আরিফ বিললাহ

গাউন পরীহিতা সুউজ্জ্বলা যুবতী। পিঠ জুড়ে বেয়ে আসা দীঘল চুল। লীলাময়ী কোমর দুলিয়ে সম্রাটের সাথে নাচছে। পাশে রয়েছে হরেক স্বাদের মদ্যপেয়ালা।

অন্য দৃশ্যে, সম্রাটপতি ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে অথবা অর্থের বদলে রাজ্যীয় গোপন কথার সস্তা বাজার করছে।

কেউ বা টাকার বিনিময়ে সেরা হারটি কেনার ধান্দা করছে। এভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও দশম দৃশ্যে ইতিহাস নারীকে তুলে ধরছে শুধুই ভ্রান্তী ও পতনের হেতু স্বরুপ।

প্রায় বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে সৎ জননীদের ঐতিহাসিক আলোকময় ভূমিকা সমূহ। এমন কি বোঝানো হয়ে থাকে ইসলামি সমাজের প্রথম যুগ দাড় হয়েছে শুধুই পুরুষদের প্রচেষ্টায়।

অন্য দিকে নারীগণ ছিলেন গৃহ পরিচর্যা ও সন্তান লালন-পালনের দায়িত্বে। এটি যদিও সুন্দর সমাজ বুননে তাদের বড় এক ভূমিকা। তাই বলে তারা শুধু মুরগির মত খাঁচাবন্দী ছিলেন না।

বরং যুগে যুগে ইসলামি সভ্যতা ও আদর্শ প্রচারে পুরুষদের থেকে তাঁরা খুব পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁরা মসজিদ নববীর পাঠাসরে অংশ নিয়েছেন। নবিজির স্ত্রীগণের কাছে তাঁদের অতি আসা যাওয়ার কারণে ঘর কানায় কানায় ভরপুর থাকতো।

যেন ছোট খাটো সাংস্কৃতিক সভা। যেখানে বিভিন্ন মাসআলা ও বাস্তব জীবনের সমস্যা নিয়ে বাতচিত করা হতো।

আয়েশা রা. বলেন, আনসারি মহিলাগণ কত চমৎকার! লাজুকতা তাঁদের দ্বীন শেখায় বারণ করেনি।

নবিজির মৃত্যুর পর তাঁরাও নববীবার্তা বহন করেছেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ইসলামি শুদ্ধ সংষ্কৃতি প্রচার করেছেন।

ফাতেমা বিনতে আলাউদ্দিন সমরকান্দী। যিনি ইসলামি ফেকাহজগতে অনুসরণীয় প্রদীপতুল্য। শিক্ষাপ্রদান করেছেন। ফেকাহ ও হাদিস শাস্ত্রে বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন।

বাদশাহ নুরিদ্দিন শহিদ-রাজ্যীয় বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর থেকে পরামর্শ নিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী কার্য পরিচালনা করেছেন। বিখ্যাত ইতিহাস লেখক কাসানি রহ. ছিলেন তাঁরই জীবন সঙ্গী।

কাসানি রহ. এর থেকে কোনো অশুদ্ধতা প্রকাশ পেলে তিনি শুধরে দিতেন। বরং প্রকাশিত ফতোওয়াগুলো তাঁদের উভায়ের নামই বহন করতো।

নবিজির মৃত্যুর পরে সাহাবাগণ পারিবারিক বিষয়গুলো জানার জন্য তাঁর ঘরে এসে ভিড় করতেন। আয়েশা রা. তাঁদের অস্পষ্ট বিষয়গুলো বলে দিতেন।

আবু মুসা আশারী রা. আয়েশা রা. এর ব্যাপারে বলেন, আমাদের কাছে কোনো হাদিছের ব্যাপারে জটিলতা দেখা দিলে আয়েশা রা. এর কাছে জিজ্ঞেস করলেই আমরা সমাধান পেয়ে যেতাম।

অন্য দিকে উম্মে সালামা রা. যিনি ফেকহি বিষয়ে বেশ জ্ঞাত ছিলেন। পাশাপাশি শিক্ষা প্রদান করেছেন অন্যদেরও। শিফা বিনতে আবদুল্লাহ। যাঁকে বলা হয় ইসলামের প্রথম
শিক্ষিকা। দক্ষতার সাথে লিখতে পড়তে শিখেছেন। শিখিয়েছেন অন্যদেরও।

তাঁর সুদক্ষতা ও সুচতুরতার ব্যাপারে মদিনার অনেকেই জানতেন। শুধু তাই নয়, হযরত ওমর রা. বাজার দেখভালের জন্য তাঁকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেন ওমর রা. তাঁকে অর্থমন্ত্রণালয়ে হিসাব বিভাগে নিয়োগ দিয়েছেন।

তিনিই প্রথম মুসলিম নারী , যিনি রাজ্যীয় কোনো মন্ত্রণালয়ে ওমর রা. এর শাসনকালে নিয়োগ প্রাপ্তা হয়েছেন। তাঁরই শিষ্যত্ব লাভ করেছেন হাফছা বিনতে ওমর রা.।

চিকিৎসা জ্ঞানে তার যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সবাই জ্ঞাত। তার সুদক্ষতার ফলে মদিনাবাসী তাকে আরোগ্য বলে উপাধি দিয়েছিলো।

উমরাহ বিনতে আবদুর রহমান। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদিস যত্নের সাতে হেফজ করেছেন। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদিস সম্পর্কে অধিকজান্তাদের মাঝে তিনিই ছিলেন তৃতীয়। তাঁর বর্ণিত হাদিসগুলো অত্যন্ত নিখুঁত প্রমাণিত হয়েছে হাদিস বিশারদদের কাছে।

বরং বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি ও নাসায়ি শরিফে তার বর্ণিত হাদিস লিপিবদ্ধ হয়েছে। হাদিস লিপিকরণ ও মুখস্ত করার ক্ষেত্রেই তাদের উজ্জ্বল ভূমিকা সীমিত ছিলো না। বরং শিক্ষা প্রদান করেছেন বিভিন্ন হাদিসের মজলিসে।

যাইনাব বিনতে আলী রা.। হুসাইন রা. এর শাহাদাতের পর তিনি মদিনায় গমণ করেন। সেখান থেকে মিশরে যান। মিশরে তিনি মহিলাদের ফেকহি বিষয়াদি শিক্ষা দানে নিয়োজিত হন।

তাঁর তালিমি জলসা শুধু মহিলাদের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং অংশ নিয়েছেন পুরুষরাও। বিশেষ করে আহলে বাইআত সংক্রান্ত মাসআলায়।

তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন ফাতেমা বিনতে হুসাইন রা.। যার চেষ্টার ফলে হুসাইন রা. এর জীবনকর্ম এখনও অমর হয়ে আছে।

অন্য দিকে কাব্যজগতে আহলে বাইআতের অবদান বিশদ ভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর বোন সাকিনা রা. আরবি ভাষা সাহিত্যে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। ভাষাজ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে তার অপার আগ্রহ ছিলো।

শুধু তাই নয় বরং সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্যসভা করতেন তিনি। যেখানে তুলে ধরতেন আরবি ভাষাজ্ঞান ও সাহিত্যসহ ফিকহি বিষয়সমূহ।

আরো ছিলেন নাফিসা বিনতে হাসান রা.। তিনি ইমাম মালেক রহ. এর শিষ্যত্ব লাভ করেছেন। মিশর যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মদিনায় ইমাম মালেক রহ. এর পাঠসভায় অংশ নিতেন। মিশরে এসে তিনি শিক্ষা দানে আত্মনিয়োগ করেন।

তাঁর মজলিসে উপস্থিত হয়েছিলেন তৎকালীন অনেক আলেম। ইমাম শাফেয়ী রহ. ছিলেন তাঁদের মাঝে অন্যতম। তাঁর মৃত্যুলগ্ন পর্যন্ত ইমাম শাফেয়ী রহ. মজলিস ত্যাগ করেননি।

মুসলিম নারীগণের ভূমিকা আহলে বাইতের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। বরং সাধারণের মাঝেও শিক্ষার আলো ব্যাপক ছিলো।

তেমনই সেরাদের একজন ছিলেন শুহদা বিনতে আহমাদ বিন আল ফাজর আল ইবরি। চমৎকার হাতের লেখা ছিল তাঁর। তৎকালীন খলিফা তাকে চিঠি, ওয়াজ এবং স্মারক লেখার কাজে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

এছারাও তিনি ভাষা, ইতিহাস ও সাহিত্যসহ একাধিক বিষয়ে পুস্তিকা লিখেছেন। একশ আটষট্টি জন বিশিষ্ট পণ্ডিত তাঁদের গবেষণাকর্মে শুহদা বিনতে আহমাদ রহ. এর সহযোগিতা নিয়েছেন।

এমন কি লোকমাঝে তিনি নারীকুলের গৌরব উপাধিতে ভূষিতা হন।

অন্যতমাদের মাঝে আরো ছিলেন ফাতেমাহ বিনতে আব্বাস বাগদাদী। ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ছাত্রীদের একজন। ইবনে তাইমিয়া রহ. তাঁর সুতীক্ষ্ম মেধা ও বিচক্ষণতার কারণে তাঁর খুব প্রশংসা করতেন।

এমন কি তিনি জটিল জটিল প্রশ্ন করতেন বলে ইবনে তাইমিয়া রহ. কে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে পড়াতে আসতে হত। তারই শিষ্যত্ব লাভ করেছেন প্রখ্যাত আলেম ইবনে যাওজি রহ.।

ইবনে হাযাম রহ. আন্দালুসী নারীদের প্রশংসায় বলেন, তাঁরাই (মহিলাগণ) আমাদের কোরান শিখিয়েছেন, কবিতা পড়িয়েছে এবং হাতের লেখা অনুশীলন করিয়েছেন।

হাফছা বিনতে আলহাজ্জ আল রুকুনিইইয়াহ ও ওলাদাহ বিনতে মুস্তাকফী তাদের মাঝে অন্যতমা। যাঁরা পরিবর্তিকালে আরব শহর ‘মরক্ব’তে শিক্ষিকা হিসেবে প্রেরিতা হন।

হাতে গোনা কয়েকজনের কথা লেখা হলো। রয়ে গেল অনেকের কথা। এসব জীবনকথা তাদের জন্য প্রমাণ স্বরূপ, যারা আমাদের দাসীর রূপ দিতে চায়। কাঁচপাত্রের মত ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে ঘরের কোণে লুকাতে চায়।

আমরা শিক্ষা লাভ করি তারা এটা চায় না। অস্বীকার করে। বরং ভিত্তিহীন খেয়ালি কথা আমাদেরও পড়িয়ে বেড়ায়। সাথে আছে অপপ্রচার। বলে, আমরা জাতিকে নষ্টের পথে ঠেলে দেই, জাতি ধ্বংসের মূল হেতু না কি আমরাই।

আর ঘরের বিষয়ে বলছেন? সভাবতই আমরা এ বিষয়ে প্রচুর আগ্রহী। প্রভু আমাদের এ বিষয়ে পারদর্শী করেই সৃষ্টি করেছেন। আর জাতি ধ্বংস ও ফেতনার ব্যাপারে আপনারাই বলুন,

বাইরে যেয়ে শিক্ষা অর্জন করব (অবশ্য দ্বীনের আওতায় থেকে), না ঘরের কপাট আটকে টিভির উপস্থাপিত সিরিয়াল গলাধবঃকরণ করব? না বসে বসে মানুষের গিবত ও অপবাদের দুষ্ট চর্চা করব?

এভাবে অর্থহীন বসে থাকলে আগত প্রজন্ম আমাদের থেকে কী আশা করবে? নিশ্চয়ই এর চেয়ে শতগুণ উত্তম হবে, আমরা শিখে উপকৃত হব এবং আমাদের হাতে প্রতিপালিত শিশুরাও উপকৃত হবে।

শিক্ষা বালিকার জন্য দূর্গ স্বরূপ। আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার মুক্তির হার স্বরূপ। এ কালের সবচে ভীতিকর বিষয় হল আমাদের অর্থহীন সময় পার করা। এটাই আমাদের (মেয়েদের) প্রাণশক্তি বিনাশ করে দিচ্ছে।

ইনিই শায়খ আস সুদাইসের ছেলে আবদুল্লাহ সুদাইস

৩ দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন যিনি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ