বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিরোনাম :
খাদেম-ক্লিনার ও শিক্ষক নিয়োগ দেবে ‘গ্লোবাল এডুকেশন ইনস্টিটিউট’ স্বাধীন দেশে অবৈধ অস্ত্রধারী সংগঠন থাকবে না: র‍্যাব মহাপরিচালক  মার্চে ৫৫২ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫৬৫, আহত ১২২৮ ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনালাপ পুতিনের তেজগাঁও আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া বায়তুল আমান মাদরাসায় ভর্তি শুরু আগামীকাল   ইরানের হামলার জন্য নেতানিয়াহুই দায়ী: এরদোগান ঝালকাঠিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বেড়ে ১৪, ট্রাকচালক আটক ইসরায়েলে হামলার বিষয়ে যা বললেন ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি ঘুমন্ত স্বামীর গোপনাঙ্গ কেটে পালালেন স্ত্রী ইরান-ই’সরায়েল যুদ্ধের পরিস্থিতির আলোকে প্রস্তুতি নিতে মন্ত্রীদের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

ভাটির শার্দূল মো. আবদুল হামিদকে অভিনন্দন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় তিনিই দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি। সম্প্রতি নির্বাচন ভবনে মো. আবদুল হামিদকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করেন নির্বাচন কর্তা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা।

এরপরই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ করা হয়। সম্ভবত আগামী ২৩ এপ্রিল নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. আবদুল হামিদ শপথ নিতে পারেন।

কামালপুর কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরবেষ্টিত উপজেলা মিঠামইনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি গ্রাম। একসময়ের অখ্যাত এ গ্রাম আজ সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত। এ গ্রামেরই মো. আবদুল হামিদ আজ দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি। যিনি হাওরাঞ্চলের গণমানুষের অতি প্রিয় নেতা। কামালপুর গ্রামেই যার শৈশব কেটেছে।

মো. আবদুল হামিদ ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মরহুম হাজি মো. তায়েব উদ্দিন ও মায়ের নাম মরহুমা তমিজা খাতুন। মো. আবদুল হামিদের শিক্ষাজীবন শুরু কামালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানে তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।

ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন ভৈরব কেবি স্কুলে এবং নিকলী জেসি স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। পরবর্তীকালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ ও বিএ ডিগ্রি এবং ঢাকার সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।

এলএলবি ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি আইন পেশায় কিশোরগঞ্জ বারে যোগদান করেন। তিনি পাঁচবার (১৯৯০-১৯৯৬ সময়কাল পর্যন্ত) কিশোরগঞ্জ জেলা বার সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৯ সালে তৎকালীন ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। ১৯৬১ সালে কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ফলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে করারুদ্ধ করে।

১৯৬৩ সালে তিনি কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৫ সালে একই কলেজের সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে কিশোরগঞ্জ সাব ডিভিশনের ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ১৯৬৬- ১৯৬৭ সালে ময়সনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৬৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তদানীন্তন ময়মনসিংহ-১৮ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম-নিকলী-তাড়াইল) আসন থেকে আবদুল হামিদ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হন। সাহসী ভূমিকার জন্য এলাকাবাসী তাকে ‘ভাটির শার্দূল উপাধি দিয়ে তার নির্বাচনী প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

কামালপুর গ্রামের অদূরে মিঠামইন পুলিশ ফাঁড়ির সামনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন-পূর্ব শেষ জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে উপস্থিত হয়ে তরুণ প্রার্থী ছাত্রলীগ নেতা আবদুল হামিদের জন্য ভোট প্রার্থনা করেন। সে নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী আফতাব উদ্দিনকে ধরাশায়ী করে জাতীয় পরিষদের কনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হন। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ভারতের মেঘালয় রিক্রুটিং ক্যাম্পের চেয়ারম্যান ও তৎকালীন সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (মুজিব বাহিনী) সাব-সেক্টর কমান্ডার পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৮ থেকে ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৬-৭৮ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময় তিনি কারারুদ্ধ হন।

১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তারপর সপ্তম জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৬ সালের ১৩ জুলাই থেকে ২০০১ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত এ পদে দায়িত্ব পালন করেন।

পরবর্তীকালে তিনি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ২০০১ সালের ১১ জুলাই থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। অষ্টম জাতীয় সংসদে তিনি ২০০১ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি সর্বসম্মতিক্রমে দ্বিতীয়বারের মতো স্পিকার নির্বাচিত হন।

কোনোরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই তিনি বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালের ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থীরূপে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন।

অতঃপর এ নির্বাচনে অন্য কোনো প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল না করায় ও প্রয়োজনীয় যাচাই বাছাই করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রাকিবউদ্দীন আহমদ ২০ এপ্রিল তাকে দেশের রাষ্ট্রপতিরূপে ঘোষণা দেন এবং ২৪ এপ্রিল তিনি রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

আমি গর্বিত তার জেলার মানুষ হিসেবে। আরও গর্বিত এই কারণে যে রাষ্ট্রের ২০তম ও ২১তম রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার পরিচয় শৈশব থেকেই। তিনি আমার প্রয়াত বড় মামির (নূরজাহান বেগম; যিনি বাজিতপুর পৌর শহরের স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ রাজ্জাকুন্নেছা পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা ছিলেন।

আর আমার বড় মামা মফিজুল ইসলাম আফ্রাদ ছিলেন বাজিতপুর হাফেজ আবদুর রাজ্জাক পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক; যে স্কুলে আমি কয়েক বছর পড়েছি।) নানাবাড়ি সূত্রে নানা হন।

মো. আবদুল হামিদের ছোট বোন মিঠামইন সদর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আছিয়া আলম সম্পর্কে আমার মামি নূরজাহান বেগমের মামি। সেই সুবাদে ছোটবেলা মামির সঙ্গে একাধিকবার তাদের বাড়ি গিয়েছি। কখনো নানা আবদুল হামিদের সঙ্গেও দেখা হতো।

তিনি আমাদের খুব স্নেহ করতেন। তারপর যখন কিছুটা বড় হলাম, তাকে দেখতাম রাজনীতির মাঠে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে প্রতিটি নির্বাচনে অন্যান্য এলাকার পাশাপাশি তিনি ছুটে আসতেন কুলিয়ারচর

উপজেলায়, এমনকি আমাদের ছয়সূতী গ্রামে। মিশে যেতেন গণমানুষের সঙ্গে। যতদূর মনে পড়ে, তিনি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্নেহধন্য ও আস্থাভাজন একজন। একজন সমাজসেবক ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মো. আবদুল হামিদ তার নির্বাচনী এলাকায় একাধিক স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

জেলার সর্বত্র রয়েছে তার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড। এ ছাড়া তিনি কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সম্মানিত সদস্য। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় তাকে ২০১৩ সালে স্বাধীনতা দিবস পদকে ভূষিত করা হয়।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী মোছা. রশীদা হামিদের সঙ্গে সংসারধর্ম পালন করছেন। রশীদা হামিদ কিশোরগঞ্জ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী। তাদের রয়েছে তিন ছেলে ও এক মেয়ে। তাদের ছেলে রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক অষ্টগ্রাম-ইটনা-মিঠামইন আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় মো. আবদুল হামিদকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। তৃণমূল থেকে ওঠে আসা এই বরেণ্য রাজনীতিবিদ ২য় বারের মতো রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার বিরল সম্মান অর্জন করেছেন। তিনি তার অসাধারণ প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা সকল শ্রেণির মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছেন-এটা তারই স্বীকৃতি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ১৯তম রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান দুজনই ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার মানুষ। এই জেলার তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন মো. আবদুল হামিদ। তার সুস্থ, সুন্দর ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি।

লেখক : কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ