শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


সিংহ ও হাতির লড়াই

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হামিদ মীর

pak-ind-e-copyযুদ্ধের কথা বলা, যুদ্ধে শত্রুকে নাস্তানাবুদ করার দাবী করা এবং শত্রুর আগামী বংশধারাকে শিক্ষা দেওয়ার শ্লোগান দেওয়া বেশ সহজ। তবে একবার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তা অব্যাহত রাখা এবং জয়লাভ করা বেশ কঠিন। আজকের যুগে যুদ্ধ শুধু দুটি দেশের সৈন্যের মাঝে নয়, বরং দুটি দেশের টেকনোলজির মাঝে হয়। আবেগ, সাহস ও বীরত্বের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, তবে যদি শত্র“র সৈন্যের পরিধি আপনার সৈন্যের চেয়ে বড় হয়, শত্র“ পুরো বিশ্বে সফ্টওয়ার রপ্তানির দাবীদার হয় এবং শত্র“র পাশে বিশ্বের এক নম্বর সুপারপাওয়ার দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে শত্র“র মোকাবেলার জন্য বীরত্বের পাশাপাশি কৌশল ও বিচক্ষণতারও প্রয়োজন রয়েছে। অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরের উড়িতে ভারতের সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্পে আক্রমণের পর থেকে ভারতে পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার আলোচনা চলছে। ভারতের মিডিয়া জনগণের মাঝে এতোটাই যুদ্ধোন্মাদনা ছড়িয়ে দিয়েছে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক হাজার বছর পর্যন্ত যুদ্ধ করার ঘোষণা করতে হয়েছে। পাকিস্তানের কিছু মানুষ মোদির ওই ঘোষণার এভাবে অর্থ করেছেন যে, মোদির ধারণামতে আগামী এক হাজার বছর পর্যন্ত পাকিস্তান টিকে থাকবে। নিঃসন্দেহে এমন অর্থ করার অবকাশ রয়েছে, তবে মোদির মতো অনিষ্টকর শত্র“র প্রতিটি শব্দের চতুর্মুখী পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এক হাজার বছর পর্যন্ত যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য এটাও হতে পারে, ভারতের যুদ্ধ শুধু পাকিস্তানের সাথে নয়, বরং একটি চিন্তাধারা, একটি দর্শন এবং একটি তত্ত্বের সাথে।

পাকিস্তান সৃষ্টি করা হয়েছে ইসলামের নামে। মোদির যুদ্ধ পাকিস্তানের সাথে নয়, বরং ইসলামের বিরুদ্ধে হবে। মোদি যে দর্শনে বিশ্বাসী, ওই দর্শন অনুযায়ী পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও নেপাল অখণ্ড ভারতের অংশ। আজ আমাদের ভুল ও সংকীর্ণতার কারণে আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের শাসকগণ মোদির পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে অখণ্ড ভারতের দর্শনে বিশ্বাসী আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের অস্তিত্বকে ভারতমাতার ভৌগলিক সীমারেখায় যুক্ত করাকে নিজের ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করেন। ভারতীয় জনতা পার্টি ও তার জোট উগ্রপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলো এই অঞ্চলের প্রতিটি মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ ও বৌদ্ধ ধর্মমতের অনুসারীকে জোরজবরদস্তিমূলক হিন্দু বানাতে দৃঢ় আশাবাদী। তারা দলিত ও আদিবাসী হিন্দুদেরও দুশমন। বিজেপির দর্শনের ভিত্তির মূলে রয়েছে বিদ্বেষ। ভালোবাসা ও শান্তি বিজেপির জন্য মৃত্যুস্বরূপ। এ জন্য মোদি যদি এটা বলেন, এসো সবাই মিলে গরিবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি, তাহলে কখনো এটা মনে করবেন না যে, তিনি যুদ্ধ থেকে পালাচ্ছেন। তিনি শুধু ধোকা দিচ্ছেন। মোদি তার সাজানো গোছানো কথা দ্বারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে কাশ্মির থেকে দূরে রাখার পূর্ণ চেষ্টা করেছেন, তবে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ সভায় বক্তৃতার সময় নওয়াজ শরীফের পক্ষ থেকে কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী বুরহান ওয়ানির কথা উল্লেখ মোদির অন্তরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কাশ্মির বিষয়ে পাকিস্তানের অনমনীয় অবস্থানের পর মোদি সর্বাত্মকভাবে পাকিস্তানের ক্ষতি করবে। তবে তিনি এ চেষ্টা করবেন যে, যুদ্ধ সূচনার অভিযোগ ভারতের বিরুদ্ধে নয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেন হয়। এ জন্য পাকিস্তানকে যুদ্ধের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা উচিত, তবে এমন প্রতিক্রিয়া যেন না আসে যে, পাকিস্তান যুদ্ধের সূচনা করছে।

আমাদের মনে রাখা উচিত, ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে বিবাদের মূল কারণ জম্মু-কাশ্মির সমস্যা। এই সমস্যার ব্যাপারে কাশ্মির ও পাকিস্তানের মোকাদ্দমা আইনগত, চারিত্রিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ের ভিত্তি বেশ মজবুত। সুতরাং আমাদের এই মোকাদ্দমা অত্যন্ত প্রজ্ঞা, বীরত্ব ও স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ নিয়ে লড়তে হবে। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শক্তি কাশ্মিরিদের আন্দোলন; তাদের দৃঢ়সংকল্প, স্থিরতা ও ত্যাগ। সারা বিশ্ব জানে, কাশ্মিরিরা ভারতের হাত থেকে মুক্তি চায়। সুতরাং পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ময়দানে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। আল্লাহ না করুন, যুদ্ধ বেধে গেলে কাশ্মিরিরা তো পাকিস্তানের পাশে থাকবে, আল্লাহর অপার সাহায্যে আমরা এ যুদ্ধ জিতেও যাব, তারপরেও ক্ষয়ক্ষতি এতো বেশী হবে যে, আমরা কয়েক দশক পেছনে চলে যাব। এ জন্য বারবার এ আরজ করতে চাই, পাকিস্তানের ভূখণ্ড থেকে কাউকে এমন ভুল করার অনুমতি যেন দেওয়া না হয় যে, যুদ্ধের অভিযোগ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আসে। যুদ্ধের প্রতি ঘৃণার অর্থ এই নয় যে, আমি যুদ্ধকে ভয় করি। যুদ্ধকে আমি এ জন্য ঘৃণা করি যে, আমি একজন সাংবাদিক হয়ে যুদ্ধকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। আল্লাহর অনুগ্রহে যুদ্ধের সময় যখনই মৃত্যুকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, তখনই তার চোখে চোখ রেখেছি। তবে আমার চোখ যুদ্ধকবলিত এলাকায় যে ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছে, তা আমি বারবার দেখতে চাই না।

এই অধম চেচেনিয়ার গ্রোজনি শহরের ধ্বংসযজ্ঞ ও বিধ্বস্ত হওয়ার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। চেচেন যোদ্ধারা রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যে বীরত্ব ও সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল আজকের যুগে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু তাদের আবেগ ও সাহস রাশিয়ার সেনাশক্তির মোকাবেলা করতে পারেনি। গ্রোজনি শহরের সবটুকুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ওই ধ্বংসস্তূপে বিচরণ করতে গিয়ে আমি আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান হিমরান আলেকজান্ডারের কাছে গোপনে কেঁদেছি। ইসরাইল ও লেবাননের যুদ্ধের সময় তিন সপ্তাহ পর্যন্ত আমাকে প্রতিদিন জঙ্গী বিমানের বোমাবর্ষণে নিষ্পাপ ও নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যুর দৃশ্য দেখতে হয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধকবলিত এলাকায় শিশুর লাশের ওপর কান্নারত মায়েদের কথা আমি ভুলতে পারব না। অধিকৃত ফিলিস্তিনের গাজা শহরের ক্যামেরাম্যান আহমদকে কখনো ভোলা যাবে না, যিনি খান ইউনুস এলাকায় তিন ফিলিস্তিন শিশুকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন। ওই তিন শিশুর ইচ্ছা ছিল, তারা ইসরাইলি ট্যাংকগুলোতে পাথর নিক্ষেপ করবে আর আমি কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে তার ফিল্ম তৈরী করব, যাতে বিশ্ব জানতে পারে ফিলিস্তিনিরা পাথর দিয়ে ইসরাইলের মোকাবেলা করছে। আমি এ কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করি। পরের দিন আহমদ এক তুর্কি সাংবাদিকের সাথে এই কাজ করতে গিয়ে শহীদ হন। দূরে কেন যাবেন? নিজেদের উত্তর ওয়াজিরিস্তানের ভুক্তভোগীদের দিকে তাকান, যেখানে এখনও বিশাল অংকের মানুষ গৃহহীন।

উত্তর ওয়াজিরিস্তানের বিধ্বস্ত বাজার ও রাস্তাঘাট দেখে আমার শ্রীলংকার জাফনা শহরের ধ্বংসের কথা মনে পড়ে। যেখানে সেনাবাহিনী তামিল টাইগারদের পরাজিত করেছিল বটে, কিন্তু মানবতা ওইখানে হারিয়ে গিয়েছিল। আইজেনহাওয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। বিজয়ী হওয়াসত্ত্বেও তিনি বলেছিলেন, তিনি যুদ্ধকে ঘৃণা করেন। কেননা যুদ্ধ ধ্বংস নিয়ে আসে। পাকিস্তানকে সর্বাবস্থায় কাশ্মিরিদের পাশে থাকতে হবে এবং তাদের জন্য মোকাদ্দমার লড়াই করতে হবে। তবে যতদূর সম্ভব যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার চেষ্টাও করতে হবে। আর যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে নির্ভীক বীরের মতো লড়তে হবে। আমি বিজয় বা মৃত্যুতে বিশ্বাস করি। অস্ত্র ফেলে দেওয়ার পক্ষে আমি নই। যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে পাকিস্তানের মোকাবেলা শুধু ভারতের সাথে নয়, আমেরিকার সাথেও হবে, যারা আফগানিস্তানের পথ ধরে ডবল গেম খেলবে। ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ হাতি ও সিংহের লড়াইয়ের মতো হবে। হাতির দেহাকৃতি ও শক্তি বিশাল হয়, সুতরাং সিংহ অত্যন্ত কৌশলের সাথে হাতির মোকাবেলা করে এবং হাতির দেহাকৃতিকেই তার জন্য দুর্বল পয়েন্ট বানিয়ে ফেলে। ওই লড়াইয়ে অধিকাংশ সময় কোনো ফলাফল প্রকাশ পায় না। কখনো কখনো সিংহ জিতে বটে, তবে হাতির সফলতা দুর্লভ ও বিরল ঘটনা। এ জন্য আমাদের সিংহ হতে হবে।

কলামটি  পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ এ প্রকাশিত

উর্দু থেকে ভাষান্তর : ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

এফএফ


সম্পর্কিত খবর