শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


আমার জলশৈশব ।  ১ম পর্ব ।  জলজ ছেলে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

salahuddin2সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর : আমার শৈশব কৈশরের অনেকটা অংশ জুড়ে আছে বিল। বিল মানে ঝিল... হাওড় আর কি। হাওড় তো অনেক বড় হয়, কিন্তু বিল এতো বড় না, আকারে ছোট। ব্যাসার্ধে ধরুন বড়জোর আট-দশ মাইল হবে। আর ছোট বিলের তো কোনো সীমারেখা নেই। এক মাইলের ব্যাসার্ধেও হতে পারে আবার পাঁচ মাইলও হতে পারে।

বিলকে আমাদের অঞ্চলে আমরা অবশ্য ‘চক’ বলি। আমাদের এলাকার এমন প্রত্যেকটা চকের আলাদা আলাদা নাম আছে। যেমন বুৎসহাটির চক (ডাকনাম বুয়াটির চক, হা হা হা), বাইল্যাপাড়ার চক, শিবপুরের চক, কাইজারবন্ধের চক...। এমন আরও অনেক নামের চক ছড়িয়ে আছে আমাদের গ্রামের আশপাশে।

শুকনো মৌসুমে ধান, পাট, সর্ষে, ভুট্টা, সবজিসহ নানা ফসল ফললেও বর্ষার সময় পুরো চকই থাকে জলের তলে। তখন কেবল শীষ নোয়ানো আউশ ধানের দোলদোল হাতছানি। ঝিরঝির বাতাস বয় যখন, ধানের শীষের দুলুনির কাছে বসলে মনে হয়- কী এক অভিরাঙা সঙ্গীত গেয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। শীষের দুলুনিতে মৃদু মসৃণ ঢেউ উঠে চকের শ্যাওলা সবুজ জলে, মনে হয় পৃথিবী এখানে স্থির হয়ে আছে। ঘুর্ণয়মান পৃথিবীর সমস্ত যান্ত্রিকতা এখানে বেমানান ঠেকে খুব।

এখনও প্রতিরাতে বর্ষা আসে, প্রতিটি দিন বর্ষার জলে টইটম্বুর হয় চকের আউশ-আমন ধানের বীজতলা। ধ্যানী ঋষির মতো ঝিম মেরে থাকে চকের জল, সবুজ শ্যাওলা, ধানের শীষ। হঠাৎ হঠাৎ দুয়েকটা বেরসিক শোলমাছের বাচ্চা লাফ দিয়ে আকাশ ছুঁতে চেয়ে ঝপ করে পড়ে ধ্যানী জলের মধ্যে। তখন ধ্যানটা ভেঙে যায় বর্ষার জলবতী চকের।

শৈশব-কৈশরে বাবা-চাচাদের সঙ্গে প্রায়ই মাছ ধরতে যেতাম। একেক চকের জন্য একেক ধরনের বিশেষায়িত জাল ব্যবহার করতে হতো। কারণ একেক চকে একেক ধরনের মাছের আনাগোনা হতো বেশি। আবার একেক দিন একেক মাছ ধরার বাতিকও থাকতো গ্রামের মানুষের। সকালবেলা চচ্চড়ির জন্য কাঁচকি, পুটি, মলা, খলসে মাছই উপাদেয়। সে মাছ ধরার জন্য বরাদ্দ হতো ... (এই দেখো, আমি সেই জালের নামটাই ভুলে গেছি। মশারির মতো ছোট ছোট ছিদ্রওয়ালা লম্বা জালগুলোর নাম কী? দু দিক থেকে দুজন বা চারজনের টানে যেগুলো? একদম ভুলে গেছি! ওগুলোর নাম সম্ভবত ছিলো টানা জাল।)

কৈ, শিং, টাকি, শোল, সরপুটি, নলা, টাটকিনি, মাগুরের জন্য বরাদ্দ থাকতো ঠ্যালা জাল। তিনটি বাঁশের লাঠিকে ত্রিভুজাকৃতির শেপ দিয়ে তিন কোণায় বাঁধা হতো জালের তিন মাথা। ত্রিভুজের লম্বা মাথা ধরে সেটাকে পানির নিচ দিয়ে কচুরিপানা বা শ্যাওলার তল দিয়ে চালান করে দিতে হতো। মাছের ঝাঁক যদি ওর মধ্যে পড়ে যায় তাহলে আর রক্ষে নেই, জালের কুশে এসে সেগুলো জমা হয়ে যেতো। চকে যেখানে কচুরিপানা বা শ্যাওলার অভয়ারণ্য থাকতো, সেখানে ঠ্যালা জালের চেয়ে উস্তাদ আর কিছু নেই। কেননা কচুরি বা শ্যাওলার যে বড় বড় দাড়ি (শেকড় আর কি) হয়, সেগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে মাছেরা। বিশেষ করে কৈ, শিং, টাকি, শোল, মাগুর, বাইম, বুতকিয়া মাছগুলো কচুরিপানার দাড়িতে লুকিয়ে থাকতে দারুণ আমুদ বোধ করে।

মাছুয়াদের কাজ হচ্ছে, ঠ্যালা জালটা ঠেলে কচুরিপানার নিচে ঢুকিয়ে দেয়া। ঢুকিয়ে দেয়ার পর ত্রিভুজের অপর দুই মাথা দুই পাশ থেকে সঙ্গে থাকা বাকি দুজনকে কচুরি সমেত টেনে তুলতে হবে। টেনে পানির উপরে তুলে কচুরিপানা সতর্কতার সঙ্গে পরখ করতে হবে। কচুরিপানার হাতখানেক লম্বা লম্বা কালো দাড়ির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে মাছেরা। একটু ঝাঁকি দিলেই সড়সড় আওয়াজ তুলে জালে গড়িয়ে পড়ে। কতোক্ষণ জালের মধ্যেই দাপাদাপি করে বটে, কিন্তু যখন বুঝতে পারে- নিয়তির লিখন না যায় খণ্ডন, তখন আর রাও করে না। জাল থেকে হাত দিয়ে ধরে সেগুলোকে রেখে দিতাম বাঁশের খালই বা সিলভারের পাতিলে।

মনে পড়ে গেলো, মাছ ধরার জন্য আমরা যেসব অ্যালুমিনিয়াম বা সিলভারের পাতিল নিয়ে যেতাম, সেগুলোকে পাতিল বলতাম না। বলতাম- ‘বুকা’। হুম... পাতিলকে কেন বুকা বলা হতো, এ রহস্য আমার অজানা। বাড়িতে যখন এসব পাতিলে ভাত বা অন্য কিছু রান্না হতো তখন এগুলোকে পাতিলই বলা হতো, কিন্তু মাছ ধরতে গেলে এগুলো হয়ে যেতো বুকা। এখন শুনতে বেখাপ্পা লাগলেও তখন কিন্তু তেমন লাগতো না- এ্যাই কাণ্ঠু, বুকাটা এদিকে দে তো!

এসব বুকায় রাখা টাটকা মাছের গন্ধ এখনও যেনো নাকে লাগছে। দুপুরের ঝকঝরে রোদ্দুরে যখন চকের মাঝখানে গিয়ে মাছ ধরে ধরে বুকায় রাখতাম, মাছের গায়ে ঝিলিক দিয়ে উঠা আঁশের রূপে মুগ্ধ না হয়ে তখন পারা যেতো না। বিশেষ করে কয়েক পদী খলসে আর পুটির গায়ের রঙ আর বাহারি শেপের যে অভিনব কারুকাজ থাকে, সে তো সৃষ্টিকর্তার এক মহান শিল্পকর্ম।

mas

ঠ্যালা জাল দিয়ে মাছ ধরার সময় মাঝে মধ্যে মাছের বদলে কচুরিপানার তল থেকে উঠে আসতো ঢাউস সাইজের ঢোঁড়া সাপ। ঢোঁড়া সাপ দেখে আমরা তখন খুব একটা ভয় পেতাম না। ঢোঁড়া সাপের বিষ থাকে না। তাছাড়া ঢোঁড়া সাপ এমনিতেও নিরীহ টাইপের সাপ, নিজের বিষহীন অক্ষমতার কারণে খুব বেশি রাও করে না। জালের মধ্যে সাপ উঠলে বাবা-চাচারা সাপের ল্যাঞ্জা ধরে ওটাকে মাথার উপরে বার দু-তিন ঘুরাণ্টি দিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারতো। অনেক সময় বাড়ির রাখাল যারা থাকতো, তারা দুষ্টুমি করে আমাদের গলার মধ্যেই পেঁচিয়ে দিতো ঢোঁড়া সাপ। বিলের পানির মধ্যেই শুরু করতাম লম্ফঝম্ফ দৌড়াদৌড়ি।

দুপুরের ঝকঝরে রোদ্দুরে যখন চকের মাঝখানে গিয়ে মাছ ধরে ধরে বুকায় রাখতাম, মাছের গায়ে ঝিলিক দিয়ে উঠা আঁশের রূপে মুগ্ধ না হয়ে তখন পারা যেতো না। বিশেষ করে কয়েক পদী খলসে আর পুটির গায়ের রঙ আর বাহারি শেপের যে অভিনব কারুকাজ থাকে, সে তো সৃষ্টিকর্তার এক মহান শিল্পকর্ম।

সাপ ছাড়াও অনেক সময় গুইসাপ উঠতো জালে। গুইসাপকে আমাদের এলাকায় বলা হয়- হুঙ্গইর; কী অদ্ভুত নাম! যাক, গুইসাপ দেখে খুব ভয় পেতাম আমি। জনশ্রুতি আছে- গুইসাপ যদি কারো শরীরে থুতু ছুঁড়ে দেয় তাহলে তার শরীরের সে অংশে পঁচন ধরে যায়। এর বিশ্বাসযোগ্যতা কতোটুকু, আমি সত্যতা পাইনি কখনো যদিও। তবুও ভয় লাগতো ওগুলোর কুতকুতে চোখ আর কালো জিহ্বা দেখে। গুইসাপের জিহ্বার বিশেষত্ব হলো, ওগুলোর লম্বা চিকন জিহ্বাগুলোর মাঝখানে আড়াআড়িভাবে কাটা। একই জিহ্বার দুটো মাথা! আর ওদেরও বদভ্যাস- একটু পরপরই ফোঁসফোঁস করে জিহ্বা বের করে। ওই দু’মুখো জিহ্বার ফোঁসফুসানি আমার বড্ড বিশ্রী লাগতো। ওগুলো থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতাম।

কিছু মাছ আছে যেগুলো খাওয়া নাস্তি। যেমন কুইছ্যা, বাইম মাছের মতো লম্বা মাছ। এগুলোর শহুরে শুদ্ধ নামটা কী? কুঁচে বলে সম্ভবত! আকারে অবশ্য বাইমের চেয়ে এগুলো অনেক বড় হয়। এগুলো জালে উঠলে ফেলে দেওয়াটাই রীতি। তবে শহুরে অনেক মানুষ নাকি এগুলো খেয়ে থাকে। বাতের ব্যথা আরও নানা রোগে এ মাছের ঝোল নাকি বিশেষ উপকারী।

‘চ্যাঙ টাকি’ নামে টাকি মাছের মতো দেখতে এক ধরনের মাছ আছে। আমাদের এলাকার অনেকে এটাকে মৌলভি টাকিও বলে। বাংলাদেশের আর কোথায় এগুলোকে কী নামে ডাকা হয়, জানি না। টাকি মাছের মতো হলেও এগুলোর মাথা আরেকটু মোটা। গায়ের রঙও কিছুটা কালো। এগুলো খাওয়া নাস্তি। কী কারণে নাস্তি তা জানি না, কিন্তু আমাদের এলাকায় এগুলো কেউ খেতো না। তবে দু-একবার কোথাও কোথাও খেয়েছিলাম সম্ভবত। ওগুলো দিয়ে বানানো ভর্তা আমার কাছে মন্দ লাগেনি। বাতের ব্যথার জন্য এর ভর্তাও নাকি বিশেষ পথ্য হিসেবে খাওয়া হয়।

‘ফুটকা’ মাছ বলে গোল এক ধরনের মাছ পাওয়া যেতো আগে। এগুলো এমনিতে আকারে ছোট থাকতো, কিন্তু হাতে নিয়ে বারকয়েক ঘুরাণ্টি দিলেই এগুলো ছোট টেনিস বলের মতো ফুলে যেতো। ঘুরানির সময় মাছগুলোর ভেতর থেকে প্যাঁ পোঁ করে আওয়াজ বের হতো। বাচ্চারা দারুণ আমুদ করতাম এ মাছ নিয়ে। এ মাছগুলোও খাওয়া নাস্তি ছিলো। এগুলো নাকি বিষাক্ত মাছ। খেলেই কম্মো কাবার! সুতরাং জীবনের রিস্ক নিয়ে খাওয়ার কোনো মানেই হয় না। ও দিয়ে তাই আমাদের হাত দিয়ে টেনিস খেলাই বেশি হতো।

আগামী পর্বে পড়ুন- জল ও জালের কাব্য

আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ